পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৯৪

 ২৭শে মার্চেই আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই যে জয়দেবপুরে বসে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় এবং সেদিনই রকীব সাহেবকেও আমাদের পরিবল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলি। এ পরিকল্পনা আমাদের অনেক আগেই করা ছিল এবং তা বাস্তবে পরিণত করার সিদ্ধান্ত সেদিনই নিই। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তাকে খোলাখুলিভাবে কিছু বলেত পারিনি, কারন রকীব সাহেব এমন এক সময় এবং এমন এক পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যাটালিয়নে এসেছিলেন যে তখন তাকে সম্পূর্ন বিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এবং তার পক্ষেও হয়ত এত অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের মনোভাব বোঝা সম্ভব ছিল না। তাই ২৭শে মার্চ যখন আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই তখনই আমি তাকে খোলাখুলিভাবে বলতে সাহস পেয়েছি। তার সঙ্গে খোলাখুলিভাবে এই ব্যাটালিয়নের পরিস্থিতি ও আমাদের পরিকল্পনা সম্পের্ক আলোচনা না করার কতকগুলি কারনও ছিল।

 (ক) লেঃ কর্নেল মাসুদ অপসারণ করে, ২৫শে মার্চ বেলা ৪টায় লেঃ কর্নেল রকীবকে এই ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহনের জন্য পাঠান হয়। লেঃ কর্নেল মাসুদকে আমরা যেভাবেই বিশ্বাস করতে পারতাম সেভাবে লেঃ কর্নেল রকীবকে বিশ্বাস করতে পারি নাই,কারন লেঃ কর্নেল মাসুদ এই ব্যাটালিয়নে প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তার মনোভাবও আমাদের সবার জানা ছিল। কিন্তু লেঃ কর্নেল রকীব কমিশন পাওয়ার পর থেকেই পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট চাকুরিরত ছিলেন এবং ব্যাটালিয়নের প্রত্যেকের নিকট তিনি ছিলেন সম্পূর্ন অপরিচিত। এই অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ন তার মনোভাব বুঝবার অবকাশ বা সুযোগ আমার হয়নি এবং তিনিও তার মনোভাব আমার নিকট প্রকাশ করেননি।

 (খ) ১ মার্চ কারফিউ জারি করে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ ঢাকার নিরীহ জনগনের উপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তাতে পাকিস্তানী যেসব ব্যাটালিয়ন অংশগ্রহন করে তার মধ্যে লেঃ কর্নেল রকীব সাহেবের ব্যাটালিয়ন ৩২ পাঞ্জাবও ছিল। ২৫ মার্চ যখন তিনি আমাদের ব্যাটালিয়নে আসেন আমি তাকে ১ মার্চের ঐ হত্যাযজ্ঞের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন এমন কিছু হয়নি; ব্যাটালিয়নের লোকজন দু'একটি ফাঁকা আওয়াজ করেছে মাত্র। এতে তার প্রতি আমার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাই তার সঙ্গে মন খুলে কখা বলতে পারছিলাম না। ঐদিন ঢাকা শহরে যে কি ঘটেছিল তা নিশ্চয়ই আজও কেউ ভোলেনি।

 রকীর সাহেব লিখেছেন ২৭ মার্চে সন্ধ্যায় তিনি উপলিব্ধ করেন যে আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। তাই তিনি পাকিস্তানীদের পক্ষ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহন করেন। তার বর্ণনা অনুসারে তার পরিকল্পার কার্যকারিতা শুরু হয় পরদিন সকাল ১০টা থেকে অথাৎ ২৮ মার্চ সকাল ১০টা থেকে।

 তিনি নিজেই লিখছেন এই ব্যাটালিয়নের একজন অবাঙ্গালী অফিসার কাজেম কামাল ও আমি ছাড়া বাকি সবাই ছিল তার কাছে অপরিচিতি। আশ্চার্যের বিষয় এই যে এমন একটি সম্পূর্ন অজানা ও অচেনা পরিবেশে কি করে তিনি এত বড় পরিকল্পনা একাই করে ফেললেন! আর ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি আমাদের ডেকে বললেন-'পরিস্থিতি এখন অসহ্য, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।' আর আমরাও তার কথা মেনে নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা দিলাম।

 ২৮ মার্চের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তার উপর মন্তব্য করা আমার পক্ষে ঠিক হবে না, কারণ ঐদিন সকাল ১০টায় আমি জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হয়ে যাই। সেদিনের ঘটনাবলীর সঠিক বিবরণ তারাই দিতে পারবে যারা ঐদিন তার সঙ্গে ছিল। যেমন মেজর মইন, ক্যাপ্টেন নাসিম,ক্যাপ্টেন আজিজ,ক্যাপ্টেন এজাজ এবং সেকেণ্ড লেফটেন্যাণ্ট ইব্রাহিম প্রমুখ।

 তিনি তার নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন-' এ সময় আমি যথেষ্ট চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারনসমূহ ছিল (১) মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল পৌঁছালেন কিনা এবং আগে কি করছেন তার খবর তখন পর্যন্ত পাই নাই।...।'এ অংশের উপর আলোচনা করতে গিয়ে লিখতে হয় যে, ঐ সময় দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট জয়দেবপুর,গাজীপুর,রাজেন্দ্রপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিল। আমাদের শক্তি বৃদ্ধির