পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৯৫

জন্য আমরা চাচ্ছিলাম ছড়িয়ে থাকা অংশগুলিকে সরিয়ে নিয়ে জায়গায় সংঘবদ্ধ হতে। ময়মনসিংহকেই সবাই একত্রিত হওয়ার উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম এবং সেখানে ব্যাটালিয়নের অন্যান্য অংশ কখন কিভাবে পৌঁছাবে তার একটা পরিকল্পনা গ্রহন করি এবং এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাটালিয়নের কিছু অংশ নিয়ে আমি জয়দেবপুর থেকে সকাল ১০টায় ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হয়ে যাই। আর বাকী অংশ ঐদিনই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জয়দেবপুর থেকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিল। আমি বুঝতে পারছি না, চলে আসার পর রকীব সাহেব আমার জন্য কেন এত উদ্বিগ্ন ছিলেন। ময়মনসিংহে আমি তো শত্রুও মোকাবেলা করতে যাইনি যে আমার জন্য তিনি উদ্বিগ্ন থাকবেন। উদ্বিগ্ন আমি ছিলাম যে ব্যাটালিয়নের অন্যান্যরা নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারল কিনা। তার উদ্বেগের প্রধান কারণ হওয়া উচিত ছিল কিভাবে ব্যাটালিয়নের বাকী সবাইকে নিয়ে নিরাপদে ময়মনসিংহে পৌছানো যায়।

 ২৯ মার্চ ভোরে যখন ব্যাটালিয়নের সবাই আমার সঙ্গে মুক্তাগাছায় মিলিত হয়, তখন আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি কমাণ্ডিং অফিসার সাহেব কোথায়? তখন অনেকে আমাকে এই কথাই বলেছে যে তারা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় অফিসার্স মেসের ব্যালকনিতে সি-ও সাহেব ও ক্যাপ্টেন নকভীকে (একজন অবাঙ্গালী অফিসার) দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। কি পরিস্থিতিতে রকীব সাহেব ঐ জায়গায় রয়ে গেলেন সে ব্যাপারে তিনি যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন সেটা কি সত্যের অপলাপ নয়? আমাদের পূর্ব পরিকল্পনামত ২৮ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জয়দেবপুর, গাজীপুর ও রাজেন্দ্রেপুর থেকে একই সময় সবাইকে নিজ নিজ কর্মস্থল ত্যাগ করে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিল। রকীব সাহেব এই সময়সূচী পরিবর্তন করে সাড়ে আটটা কেন করেছিলেন তা তিনি লেখেননি।

 তার নিজের কথা অনুযায়ী সাড়ে আটটায় রাজবাড়ী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা তখন পর্যন্তও তিনি যেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না এবং ৮ টা ৪২ মিনিটে তিনি তার কামরায় চলে যান এবং সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন, যে কেউ এসে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। যেখানে তার ৮টা ৩০ মিনিটে জয়দেবপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা সেখানে তিনি ৮টা ৪২ মিনিটে তার কামরায় ফিরে গেলেন কেন? এটাই কি তার ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যাওয়ার লক্ষণ ছিল?

 ক্যাপ্টেন নকভীর হাতে সারা রাত আটকে থাকার যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন সেটাও কি গ্রহণযোগ্য? তার নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা যে সেই অনিশ্চিত দিনগুলিতে আমরা সর্বক্ষণই সশস্ত্র থেকেছি, কখনও নিরস্ত্র অবস্থায় থাকিনি। সেদিনের সে অনিশ্চয়তা ও সঙ্কটময় সময়ে তার সঙ্গে অস্ত্র না থাকাই কি অস্বাভাবিক ছিল না?

 তার নিকট আমার আরও জিজ্ঞাস্য যে, গোলাগুলির মুখে যখন এই ব্যাটালিয়নের সবাই চলে আসতে পারল তখন কেন চলে আসতে পারলেন না ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার? পাকিস্তানীরা তো জয়দেবপুর রাজবাড়ি ঘেরাও করেছিল ২৯ মার্চ দুপুরের পর। আমাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঐকান্তিকতা যদি সেদিন সত্যি তার থাকত তাহলে ২৮ মার্চের সারারাত ও ২৯ মার্চের দুপুর পর্যন্ত সময়টুকু কি যথেষ্ট ছিল না? ২৯ মার্চের ভোরে যখন রাজবাড়ীতে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী স্ট্রাফিং ও বোমাবর্ষণ করছিল তখনও কি তিনি পারলেন না এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে?

 ২৯ মার্চ দুপুরের পর ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী এসে জয়দেবপুর রাজবাড়ী ঘেরাও করে ও রকীব সাহেবকে বন্দী করে নিয়ে যায় এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসারদের ন্যায় তাকেও সেলে রাখা হয়। ঐ সময় সেলে থাকাকালীন সময়ে অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসারদের ভাগ্যে যখন নানা প্রকার লাঞ্ছনার শেষ ছিল না তখন তার প্রতি কর্তৃপক্ষের সদয় ব্যবহারের কারণ কি ছিল? অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসারদের যখন পশুর মত ছোট একটি সেলে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল তখন তার থাকার জন্য কেন বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিল? এসবের জবাব কি তিনি দিতে পারবেন?