পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৯৮

থেকে টেলিফোনে বললেন....আমাদের পিছনে ফেলে যাওয়া কালিহাতী ব্রীজ উড়িয়ে দিতে। আমি মেজর নূরুল ইসলামকে বললাম ব্রীজ উড়ানোর মত তেমন কোন এক্সপ্লোসিভ নেই। কেননা তখন আমার নিকট আশি পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ ছিল। তা দিয়ে সম্ভব হলে আমি চেষ্টা করবো। আমি কালিহাতী ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য পিছনে ফিরলাম। কালিহাতী ব্রীজ উড়ানোর জন্য পরিকল্পনা নিচ্ছিলাম। এমন সময় কাদের সিদ্দিকী সেখানে পৌঁছেন এবং তাঁকে আমরা টাঙ্গাইলে ফেলে আসাতে দুঃখ প্রকাশ করি। গ্রামের ও আশেপাশের লোকজন তখন অনেক জমা হয়েছে। তারা আমার ব্রীজ উড়ানোর কথা শুনে আপত্তি করেন। কেননা চতুর্দিকে গ্রাম ছিল। পাঞ্জাবীরা তাদের অত্যাচার করবে, এ জন্য গ্রামবাসী ব্রীজ উড়ানোর পক্ষে মত দেন নাই। আমার নিকটও অল্প এক্সপ্লোসিভ থাকায় ব্রীজ উড়ানো সম্ভব হল না, কাদের সিদ্দিকী আমার কাছে একটা পিস্তল চাইলেন। কিন্তু পিস্তল না থাকায় তাকে দিতে পারলাম না। তারপর সেখান থেকে সোজা ময়মনসিংহ রওনা দিই। বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে ময়মনসিংহে পৌঁছলাম। ময়মনসিংহে চতুর্দিকে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। আমরা পাঁচটা কোম্পানী তখন ময়মনসিংহে একত্রিত হয়েছি। সেখান থেকে আমাদের অপারেশন পরিকল্পনা শুরু করি। মেজর শফিউল্লাহ তখন আমাদের কমাণ্ডিং অফিসার। সেখানে জনসাধারণ ও নেতৃবৃন্দ উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করি।

 ৩০শে মার্চ ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অফিসার ও সৈন্যরা ময়মনসিংহে ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় খবর পাঠাই ও যোগাযোগ করি। সীমান্ত এলাকার সমস্ত ইপিআরদের খবর দিই সীমান্ত এলাকা ছেড়ে ময়মনসিংহে পৌঁছার জন্য। ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ময়মনসিংহ থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এ খবর বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই। অয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের খবর পাই। চট্টগ্রামের ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ইপিআর-এর সঙ্গে পাকিস্তনী সৈন্যদের যুদ্ধ চলছে, সে সমস্ত খবর আমরা পাই। রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। এবং জানতে পারি যে রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ায় পাঞ্জাবী সৈন্যরা দারুণভাবে মার খেয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বহু ইপিআর ও সাবেক সৈন্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। একজন সুবেদারের কমাণ্ডে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠানো হল মধুপুর গড়ে-পাকিস্তানী সৈন্যরা ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিনা তার খোঁজখবর নিতে এবং অবলম্বন করতে। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সমস্ত সৈন্য নিয়ে ট্রেনে নরসিংদী হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবো। এমন সময় খবর পেলাম কুমিল্লার ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেছে। তখন আমরা দুটি বেঙ্গল রেজিমেণ্ট একত্র হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই এবং ঢাকার দিকে অগ্রসর না হয়ে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে ভৈরব রওনা হলাম ৩১শে মার্চ রাতে। পুরা ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ পৌঁছলাম ১লা এপ্রিল।

 ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) মতিয়ূর রহমানের কমাণ্ডে ইপিআর-এর একটা কোম্পানী পাঠান হলো নরসিংদীতে। মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে একজন অফিসার পাঠালেন ভৈরবে। ভৈরব থেকে তিনি কিশোরগঞ্জ চলে গেলেন মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে। সিদ্ধান্ত হলো আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছালাম। চট্টগ্রাম থেকে মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার এবং ডেপুটি চীফ অব স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি) জিয়াউর রহমানকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া পৌঁছার কথা বলা হলো। এবং আমরা ২য় এবং ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সমস্ত সৈন্য তেলিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হবার কথা জানালাম।

 আমরা ২য় বেঙ্গল এবং ৪র্থ বেঙ্গল তেলিয়াপাড়া পৌঁছলাম। ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এক কোম্পানী আশুগঞ্জ পাঠান হয়। অন্য আর এক কোম্পানী সিলেট চলে যায়। আমি আলফা কোম্পানী অর্থাৎ আগঞ্জে পৌঁছি ৩রা এপ্রিল। আমার সঙ্গে অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন নাসিম। ক্যাপ্টেন নাসিম ছিলেন কোম্পানী কমাণ্ডার,আর আমি ছিলাম সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড। এখানে আমরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলি। জনসাধারণ আমাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করেন। কিছু আনসার ও মোজাহিদ রিক্রুট করি। কিছু নিয়মিত সৈন্যসহ এক প্লাটুন সৈন্য পাঠাই লালপুরে (আশুগঞ্জ থেকে দেড় মাইল দক্ষিণ দিকে)।