পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২০১

ময়মনসিংহ ও অন্যান্য এলাকার সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ [১]সিপাই আফতাব হোসেন

২৪-৭-১৯৭৪

 ময়মনসিংহে খাকডোরে ইপিআর-এর ২ নং শাখা ছিল। উইং কমাণ্ডার ছিল ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস (পঃ পাকিস্তানী), সুবেদার মেজর জিন্নত গুল (পাঠান), নায়েব সুবেদার খান বাহদুর, নায়েব সুবেদার হজরত খান, নায়েব সুবেদার রাজা বেলাল (পঃ পাকিস্তানী)।

 ২৬শে মার্চ ইপিআরকে আর্মস-এম্যুনিশন দেয়া হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। এবং উইং হেডকোয়ার্টারের চারিদিকে পরিখা-মরিচা খনন করার নির্দেশ দেয়া হয়। ঐদিনই দুপুরের পর হাজার হাজার স্থানীয় ছাত্র-জনতা দা, লাঠি, বল্লম প্রভৃতি নিয়ে ময়মনসিংহ ইপিআর হেডকোয়ার্টার ঘেরাও করার চেষ্টা করে। বাঙ্গালী সুবেদার সি-কোম্পানী কমাণ্ডার ফরিদ আহমদ ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে মেগাফোনে বলেন যে, আপনারা চলে যান। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সি কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর নূরুল ইসলামের কোম্পানীও উইং হেডকোয়ার্টারের গ্রাউণ্ডে তাঁবুর মধ্যে ছিল। মেজর নুরুল ইসলামও মাইকে জনতাকে চলে যেতে বলেছিলেন। কিছুক্ষণ পর জনতা চলে যায়।

 ২৭শে মার্চ দুপুরের পর আমাদের উইং কমাণ্ডার কমর আব্বাস সমস্ত ইপিআরকে অফিসের সামনে মাঠের মধ্যে একত্রিত করেন। তারপর সমস্ত ইপিআর-এর উদ্দেশে ভাষণ দেন। সামরিক আইনের কয়েকটি বিধিনিষেধ তিনি আমাদেরকে পড়ে শোনালেন এবং বলেন, এখন থেকে দুইজনের মধ্যে কোন আলাপ- আলোচনা করা চলবে না, যদি কেউ করে আমি নিজে গুলি করে তাকে মেরে ফেলব। কোন বাঙ্গালী যদি কোন অপপ্রচারে লিপ্ত হয় তাহলে ' মেরা পহেলা গুলি উসকা সিনাকে সিনাছে নিকাল যায়েগি।'

 ২৭শে মার্চ বিকেল বেলায় আমি, সিপাই ইদ্রিস রেডিওতে খবর শুনলাম যে ঢাকাতে পিলখানা, রাজারবাগ পাকিস্তানী সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে। তখন আমি সিপাই নান্নুকে (১৪৩৬৮) বললাম যে ঢাকাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা বাঙ্গালীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমাদের নিকট থেকে হয়ত অস্ত্রশস্ত্র জমা নিয়ে নিতে পারে। এক বিন্দু রক্ত থাকতে অস্ত্রসমর্পণ করব না বলে নান্নুকে বললাম। তার কিছুক্ষণ পর নায়েক সুবেদার খান বাহদুর (পাঠান) এবং পাকিস্তানী হাবিলদার আজিম আমাদের ৭নং প্লাটুনে আসলেন এবং স্বয়ংক্রিয় সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র জমা দেবার নির্দেশ দেন এবং এরিয়ার বাইরে ডিউটিতে যেতে বলে। তখন আমি আর নান্নু বললাম, দস্তখত করে হাতিয়ার এবং এম্যুনিশন নিয়েছি। এক বিন্দু রক্ত থাকতে তা জমা দেব না। তারপর তারা চলে যায়। সন্ধ্যর সময় খানা খাবার জন্য সবাইকে ৫ মিনিট সময় দেয়া হয়। কিন্তু আমি হালকা মেশিনগান নিয়ে বসে রইলাম এবং নান্নু ও অন্যান্য সবাই খানা খেতে চলে যায়। হাবিলদার আজিমের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। আজিম আমাকে” তোম তো আজকাল সাচ্চা কমাণ্ডার বন গায়া।” বলে ঠাট্টা- পরিহাস করে। তখন আমি আজিমকে বলি যে, আমি বাঙ্গালী ছেলে। এটা বাংলাদেশ। আমার হাতে হালকা মেশিনগান আছে। এক্ষুনি এক ব্রাশ মেরে দেব। তখন খান বাহাদুর আমাকে অজুহাতে বন্দী করার চেষ্টা করে। তারপর সিপাহী নান্নু খানা খেয়ে চলে আসে। দুইজন একত্রে হবার দরুন আমাকে বন্দী করতে পারে নাই। তারপর সন্ধ্যা থেকে রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত পাকিস্তানীরা আমাদেরকে উইং হেডকোয়ার্টারের পেট্রল ডিউটি করায়। ডিউটি শেষে সমস্ত ইপিআরকে এক জায়গায় জমা করে। উইং কমাণ্ডার কমর আব্বাস এবং সুবেদার মেজর জিন্নাত গুল আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে, 'জোয়ান লোগ রাত কো ডিউটি কাজ জরুরত নেহি হায়। তুম লোগ নিন্দ যাও।' তারপর সবাই ব্যারাকে চলে যায়।


  1. বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত।