পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২০৬

 আমার বহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার সময় অন্যান্য কয়েকটি দলও এস আমার দলের সঙ্গে যোগ দিল। শত্রুর অগ্রগতিকে বিলম্বিত করার জন্য হালকা মেশিনগানের সাহায্যে আমরা গুলি করতে থাকলাম। রাত দুটোয় এসে আমরা পৌঁছলাম চৌমুহনীতে। আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই সেখানে এসে একত্রিত হলাম। আমাদের কোম্পানীর সমস্ত সৈন্যই ছড়িয়ে পড়াতে আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি বলতে কি- আমার অবস্থা ছিল ঝড়ের সমুদ্রের ছিন্নপাল নৌকার মাঝির মত। এখন সবাইকে এক স্থানে পেয়ে আমি খোদার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।

 চৌমুহনীতে এসে আমি কোম্পানীর সবাইকে পেলাম সত্য, কিন্তু আবার নতুন বিপদের সম্মুখীন হলাম। হালকা মেশিনগান সজ্জিত আমার কয়েকটি সৈন্যদল গুলিবর্ষণ করে শত্রুসৈন্যদের অগ্রগতিকে বিলম্বিত করতে সক্ষম হলেও, শত্রুর পার্শ্ববর্তী অগ্রগতিকে বাধা দিতে সক্ষম হল না। আর শত্রুর সবদিকের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখাও ছিল অসম্ভব-কারণ আমাদের সংখ্যাল্পতা। সংখ্যায় শত্রুসৈন্য ছিল আমাদের তুলনায় দশগুণ। ভারতীয় সীমানা থেকে চৌমুহনীর দূরত্ব মাত্র দুই মাইল। কিন্তু এই দুই মাইল রাস্তা সেদিন রাতে আমাদের কাছে অন্তহীন বলে মনে হয়েছিল।

 রাতের শেষের দিক তখন। তখন ভোর চারটা। শত্রুরা শুধু গুলি করতেই এগিয়ে আসছিল না, তারা এগিয়ে আসছিল ঘরবাড়ি, গাছপালা জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে।

 ভোর সাড়ে চারটার দিকে তারা ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। শত্রুবাহিনী তখন আমাদের পশ্চাদ্ভাগের ব্যূহ প্রায় ভেদ করে ফেলেছে। আমাদের বাহিনীর তিন দিক বেষ্টন করেছে তারা। সামনে, দক্ষিণে এবং বামে। তখন ঐ নিতান্ত ফাঁদে পড়া অবস্থার মধ্যেও আমরা মনোবল না হারিয়ে তিনদিকে হালকা মেশিনগানের সাহায্যে অবিরাম গুলি চালাতে লাগলাম। আমাদের প্রতিজ্ঞাঃ আমরা শত্রুদের কিছুতেই আমাদরকে ঘেরাও করতে দেব না। আমাদের হাতে তখন ছিল মর্টার আর ৫৬টা গোলা। নিরুপায় হয়ে শত্রুসৈন্যের উপর আমি মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করলাম। গোলার সংখ্যা কম হওয়াতে প্রতি দু-তিন মিনিট অন্তর শত্রুর অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করছিলাম। সেদিন মর্টারটি আমাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে বিধাতার আর্শীবাদের মত সাহায্য করছিল।

 সূর্য ওঠার পর দেখতে পেলাম শত্রুরা আমাদেরকে সম্পূর্নভাবে ঘিরে ফেলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। প্রায় ১৪ ঘণ্টা ধরে আমাদের সঙ্গে তাদের গোলাগুলি বিনিময় চলল। অবশেষে সকাল ৯টার দিকে আমরা সিদাই থানায় পৌঁছাতে সক্ষম হলাম।

নরসিংদী-আশুগঞ্জ সশস্ত্র প্রতিরোধ

ব্রিগেডিয়ার মোঃ মতিউর রহমান বীর প্রতীক[১]

 সুবেদার মেজর সুলতানের আমলে আমার পরিচয় হয় ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল নরসিংদীতে। আমি ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে যশের সেনানিবাসের ২৫ বেলুচ রেজিমেণ্ট ছেড়ে ২৭শে মার্চ ময়মনসিংহ পৌঁছি। ময়মনসিংহে ইপিআর-এর এক কোম্পানী নিয়ে নরসিংদী হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হই যুদ্ধ করার জন্য। ৩১শে মার্চ নরসিংদী পৌঁছি। সুবেদার মেজর সুলতান তখন ঢাকা থেকে সামান্য কয়েকজন লোকসহ নরসিংদী পৌঁছে এবং ১লা এপ্রিল আমার সাথে যোগ দেয়। ঢাকার লোকজন যখন মার খেয়ে দিশাহারা হয়ে শহর ছেড়ে পালাইতেছিল, তখন সুলতান সাহেব


  1. * ১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। বিবরণটি দৈনিক 'সংবাদ' ৩ মার্চ ১৯৮৩-এ প্রকাশিত সুবেদার মেজর সুলতান আহমদ বীরবিক্রম' শিরোনামে তাঁর রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।