পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২০৮

বিপদের আশংকা কম। ভাবলাম ওদের সাথে মিলে যুদ্ধ করার কথা ছিল, তা আর হলো না। এখন আমরা শেষ মুহূর্ত গুনছি। চারদিক থেকে পাকিস্তানী বাহিনী জাল গুটিয়ে আনবে আর আমাদের জীবিত ধরবে।

 আরো যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মত গুলিগোলা বলতে কিছুই নেই। লোক ক্ষুধায় কাতর। ১১ই এপ্রিল নরসিংদীর পতনের পূর্ব থেকে ১৪ই এপ্রিলের মধ্যে অনেকের বেলা সামান্য আহার জুটেছে। মানুষের জীবন তার অনুভূতির নিকট কত করুণ এবং কঠোর অনুভব হয় তখন হয়ত বুঝতে পেরেছি। আমি কমাণ্ডার হিসেবে তাদেরকে গুলিগোলা দিতে পারছি না যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। খানা দিতে পারছি না ক্ষুধার জ্বালা মিটাতে। কেউ আমাদের সাহায্য করবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে এ রকম আশ্বাসও দিতে পারছি না। কারণ, তখনও জানি না কোথাও থেকে কেউ সাহায্য করবে কিনা, কে কোথায় যুদ্ধ করছে বা লোকজন যুদ্ধ করছে কিনা তাও জানি না।

 বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে আমি মনস্থির করেছি এই স্থান আমাদের ছড়াতে হবে। খালি হাতে এখানে বসে মরার কোন অর্থ নেই। সুবেদার মেজর সুলতান (তখন নায়েক সুবেদার) সহ দু'জন আমার প্লাটুন কমাণ্ডার ছিলেন। আমি ব্রহ্মপুত্র নদের রামনগর ব্রীজের পার্শ্বে যেখানে আমার অবস্থান ছিল আসতে বললাম। প্লাটুন কমাণ্ডার আসার পর জিজ্ঞেস করলাম কি অবস্থা। তারা বলল, স্যার আপনি তো ঘুরে দেখে এলেন। জওয়ানরা প্রায় শূন্য হাতে বসা।

 আমি বললাম, সুলতান সাহেব, মালেক সাহেব আমাদের এলাকা ছাড়তে হবে। খালি হাতে এখানে বসে মরার কোন অর্থ নেই। আমি কথাটা বলার সাথে সাথে দু'জনেই হাউমাউ করে শিশুর মত চীৎকার করে কেঁদে উঠল। বলল, স্যার কাপুরুষের মত পালিয়ে কোথায় যাব, দেশ কি স্বাধীন হবে না? তাদের কান্নায় আমারও দুচোখে অশ্রু নেমে এলো। তাদের কান্নায় এবং আবেগে প্রায় ১৫/২০ সেকেণ্ডের মত মনে হল আমি আমার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলছি। মানুষের জীবনে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত থাকে। এই মুহূর্তটা আমার জীবনে কিভাবে মূল্যায়ন করব জানি না। অনেক সময় মৃত্যু বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু তখন জীবন মনে হয় রাবার ইলাষ্টিকের মত দীর্ঘই হয়।

 একটু সুস্থির হয়ে বললাম, এখান থেকে চলে যাওয়ার অর্থ এই নয় আমরা আর যুদ্ধ করব না। আজকে যদি এই হত যে আমাদের ৪০/৫০ জনকে গুলি করে মারলে তারা আমাদের স্বাধীনতা দিবে তাহলে আমি আপনাদের কমাণ্ডার হিসেবে কথা দিচ্ছি আমিই প্রথম মরতাম। যুদ্ধ আমাদের চালিয়ে যেতে হবে যতদিন বেঁচে থাকব, যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে। এখান থেকে চলে যেয়ে আমরা গোলাগুলি সংগ্রহ করব, আবার যুদ্ধ করব। এখন এখানে খালি হাতে বসে থাকলে আস্তে আস্তে জাল গুটিয়ে আনবে এবং আমাদের জীবিত ধরবে আর গুলি করে মেরে ফেলবে। বুঝিয়ে বলার পর মেনে নিল। বলল, স্যার আপনি আমাদের কমাণ্ডার, আপনি যা ভাল বোঝেন তা আমরা নিশ্চয় মেনে চলব। তবে স্যার, আপনি ছেলেদের বুঝায়ে বলেন কারণ তারা মানসিকভাবে অতি জেদি হয়ে আছে। প্রত্যেকটা অবস্থানে যেয়ে জওয়ানদের বুঝিয়ে বলে ছোট ছোট গ্রুপে বিভিন্নভাবে অবস্থান ত্যাগ করতে বললাম। বলে দিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যাও, শুনেছি ওখানে ২য় ইস্ট বেঙ্গল এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আছে। ওখানে যেয়ে যোগ দাও। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে আবার দেখা হবে। সুলতান সাহেব এবং মালেক সাহেবকেও তাদের লোকজনের পিছনে যাওয়ার হুকুম দিলাম। দু'জন আমার দু’কাঁধে মাথা রেখে শিশুর মত হাউ মাউ করে কাঁদল। একটা সৈনিকের এমনি এক পরিস্থিতির কান্না অনুভব করা যে কত হৃদয় বিদীর্ণকারী সে আমি বুঝেছি। যদিও এটা অতি ক্ষুদ্র ঘটনা, তবু আমার জীবনের একটা বিশেষ ক্ষণ। দু'জন বলল, 'স্যার, আপনি যাবেন না? “আপনারা গেলে”।

 ওরা চলে গেলে সমস্ত এলাকাটা ঘুরে দেখলাম এখনও কেউ বাকী আছে কিনা। সুলতান সাহেব যাওয়ার সময় বলে গেল, 'স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করব।”