পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২০৯

 সবাই চলে গেলে নিঃসঙ্গতা আর অবসাদ মনটাকে ছেয়ে ফেলল। জীবনটা মনে হচ্ছিল সত্যি খুব দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এত গোলাগুলি হল, মরে গেলে তো রক্ষাই পেয়ে যেতাম। যাক আমি আমার কাহিনী লিখছি না, যাদের জন্য লিখছি ওখানেই ফিরে যাই। ১৪ই এপ্রিল রাতে যেয়ে কুলিয়ারচরে সুলতান সাহেব এবং তার সঙ্গী ১০/১৫ জন জওয়ানের সাথে দেখা। দেখে তাঁর কি আনন্দ। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হৈচৈ করে কিভাবে যে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেছেন তা ঠিক বলতে পাবর না।

 তারপর থেকে কোনদিন সুলতান সাহেব আমার থেকে আর বিচ্ছিন্ন হননি। প্রতিটি অপারেশনে তিনি আমার সাথে ছিলেন। সিলেটের নলুয়া চা বাগানে দিনের বেলায় আমরা যে এ্যামবুশ করি তার উপর সুলতান বীরবিক্রমে পদক পান। আখাউড়া আক্রমণের সাথে ছিলেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন যুদ্ধে আমার সাথে ছিলেন।

সাটিয়াচড়ার যুদ্ধ[১]


 টাঙ্গাইল শহর তখনও মুক্ত অঞ্চল। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জেলায় জেলায়, শহরে ও গ্রামাঞ্চলে প্রতিরোধের সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় বেতার মারফত রক্তপিপাসু পাক-সৈন্যদের হিংস্র আক্রমণ আর বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষদের গৌরবময় প্রতিরোধের কাহিনী প্রচারিত চয়ে চলেছে।

 হামলাকারীদের দল তখনও টাঙ্গাইল জেলায় এসে পৌঁছাতে পারেনি। টাঙ্গাইল শহরে মুক্তির উৎসব চলেছে। রাজপথের দু'ধারে প্রতিটি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। 'জয় বাংলা' সংগীতে সারা শহর মুখরিত। কিন্তু সমস্ত আনন্দ - উৎসবের পেছনে আসন্ন বিপদের কালো ছায়া। শহরের মানুষ হাসতে গিয়েও প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারে না। আকাশবাণী নিত্য নতুন দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে আসছে, মুক্ত শহরগুলি একের পর এক পাক-সৈন্যদের অধিকারে চলে যাচ্ছে। তারপর সেই হিংস্র জল্লাদের দল সেই সমস্ত শহরের অধিবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করে চলেছে। এখনও ওরা ময়মনসিংহ জেলা ও টাঙ্গাইল জেলা থেকে দূরে আছে কিন্তু কতদিন তারা এভাবে থাকতে পারবে। দু'দিন আগেই হোক আর পরেই হোক ওরা এখানে এসে হামলা করবেই। সেদিন? সেদিন টাঙ্গাইলের মানুষ কেমন করে ওদের প্রতিরোধ করবে? কেমন করে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করবে?

 আজ সারা বাংলাদেশের মানুষের মন স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত। সারা প্রদেশের মানুষ কখনও এভাবে একতাবদ্ধ হয়ে ওঠেনি। টাঙ্গাইলের মানুষ-অতি সাধারণ মানুষও তাদের বাইরে নয়, তারাও তাদের সঙ্গে একতালে পা মিলিয়ে চলবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু সেই সংগ্রামের প্রস্তুতি কোথায়? কোথায় অস্ত্র, কোথায় চালনার শিক্ষা ব্যবস্থা? কামান বন্দুকের বিরুদ্ধে তো আর লাঠি-সোঁটা বা বর্ণা বল্লম নিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। প্রতিরোধের দায়িত্ব সামনে আসতেই এই প্রশ্নটা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।

 তবু তাদের যেটুকু সম্বল তাই নিয়ে তারা প্রতিরোধের জন্য তৈরী হচ্ছে। তাদের সামনের সারিতে আছে কিছুসংখ্যক ইপিআর বাহিনীর যোদ্ধা। স্থানীয় ছাত্র ও যুবকের তাদের কাছ থেকে রাইফেল চালানোর ট্রেনিং নিচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র বলতে ই,পি,আর বাহিনীর সৈন্যদের হাতে কিছু রাইফেল আছে। আর আছে গুটিকয়েক পুরানো ধরনের মেশিনগান। এই নিয়েই তারা আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত, সুশিক্ষিত পাক-সৈন্যদের সাথে লড়াই করবে। এই দুই অসব শক্তি-সংঘের পরিণতি কি হতে পারে, সেটা কি তারা অনুমান করতে পারে না? পারে বই কি। কিন্তু তার পরিণতি যাই হোক না কেন, প্রতিরোধে তারা তাদের


  1. সত্যেন সেন রচিত 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ আগস্ট ১৯৭১, কলিকাতা থেকে সংকলিত। জায়গাটি আসলে নাটিয়াপাড়া। ভুলক্রমে সাটিয়াচড়া বলে উল্লেখিত হয়েছে।