পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২১০

মাতৃভূমিকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারবে না। সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে প্রতিরোধের সংগ্রাম চলছে তারাও তার সঙ্গে সামিল থাকবে।

 অবশেষে সেই আশঙ্কা একদিন সত্যসত্যই প্রত্যক্ষ সত্য হয়ে দেখা দিল। নিছক জনরব নয়, প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শোনা গেল পাক-সৈন্যদল ট্রাকের পর ট্রাক বোঝাই করে টাঙ্গাইলের দিকে এগিয়ে আসছে। ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কের দু'ধারে গ্রামগুলি তাদের হামলার ফলে বিপন্ন ও ব্যতিব্যস্ত। পাকসৈন্যরা এই সমস্ত গ্রামের নিরীহ অধিবাসীদের ঘরে ঘরে গিয়ে হানা দিচ্ছে, তাদের গরু-বাছুর কেড়ে নিয়ে এসে নিজেদের ভোজের উৎসব চালাচ্ছে। খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে আসছে। ঘরের মেয়েরাও তাদের লুণ্ঠনরত হাত থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে না।

 গ্রামের মানুষ প্রাণের ভয়ে আর মান-ইজ্জতের ভয়ে যে যেদিকে পারে পালাচ্ছে।

 এইভাবে মানুষ নামধারী, এই হিংস্র পশুগুলি বিভীষিকা ছড়াতে চলে আসছে। ওরা ওদের রক্তাক্ত থাবা উদ্যত করে ছুটে আসছে টাঙ্গাইলের দিকে। টাঙ্গাইলের মানুষ হুঁশিয়ার। দেশপ্রেমিক সন্তানগণ, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য তৈরী হও-সংগ্রাম পরিষদের প্রচার-ভ্যান ঘুরে ঘুরে মাইকযোগে উদ্দীপনাময়ী বাণী ছড়াতে লাগল। আক্রমণকারী পাক-সৈন্যবাহিনী প্রথম বাধা পেল সাটিয়াচড়া গ্রামে।

 ইপিআর বাহিনীর সৈন্যরা পাঁচটি ট্রেঞ্চ কেটে তার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। পথের দু'ধারে ঝোপঝাড়ের আড়ালে রাইফেলধারী ছাত্র ও যুবকেরা পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাকসৈন্যরা এর আভাসটুকুও পায়নি। তারা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসছিল। এখানে যে কোন ভয়ের কারণ আছে তা তারা ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ তাদের চমকে দিয়ে কতকগুলি মেশিনগান ও রাইফেল গর্জে উঠল। বৃষ্টির মত ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির ঘায়ে অপ্রস্তুত পাক-সৈন্যরা ধরাশায়ী হয়ে পড়তে লাগল। নির্জন ও শান্ত পল্লীপথ এক মুহূর্তে রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল।

 প্রতিরোধকারী দেশভক্তরা বিপুলসংখ্যক শত্রুঐসন্যের বিরুদ্ধে একটানা লড়াই করে চলেছে। বেশ কিছুকাল এই লড়াই চলেছিল।

 হামলাকারী পাক-সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে কঠিন প্রতিরোধ পেয়ে একটু পেছনে হটে গেল। ইতিমধ্যেই তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার পেছনে থেকে আরও অনেক সৈন্য পৌঁছে গেছে। এবার কামান-মর্টারের সজ্জিত ছাবিবশটি ট্রাক বোঝাই সৈন্য সামনে এগিয়ে এল। মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে লক্ষ্য করে তারা অবিরল ধারায় গোলাবর্ষণ করে চলল। তারা ভাবতেও পারেনি যে, মাত্র তেইশ জন ইপিআর-এর যোদ্ধা ট্রেঞ্চের ভিতরে থেকে তাদেরকে প্রতিরোধ করে চলেছে। তাদের সম্বল ছিল মাত্র দুটি হালকা মেশিনগান, আর কিছু রাইফেল। তাই দিয়েই তারা কামান আর মর্টারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।

 জীবন পণ করে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু এই প্রবল গোলাবর্ষণের মুখে এরা তাদের কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবে। প্রতিরোধ যখন চুরমার হয়ে ভেঙ্গে গেল, তখন ট্রেঞ্চের এই তেইশ জন যোদ্ধার মধ্যে একুশ জন নিহত হয়েছে। কোথায় ছিল এদের বাড়িঘর কে জানে। কোথায় ছিল এদের বাপ-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা! এরা কোথায় কিভাবে প্রাণ দিল, সেই বীরত্বপূর্ণ কাহিনী কোন দিন এদের কাছে পৌঁছাবে কিনা, তাই বা কে জানে!

 লড়াই থেমে গেছে। এদের কামানগুলি কিন্তু তখনও গোলাবর্ষণ করেই চলেছে। এবার এদের আক্রমণের লক্ষ্য সাটিয়াচড়, গোড়াই আর তার আশেপাশের গ্রামগুলি। তাদের রকেটের আগুনে সেইসব গ্রামের ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হতে লাগল। এরপর গোলাবর্ষণ থামিয়ে ওরা ঘরে ঘরে চড়াও হয়ে হত্যালীলা চালিয়ে যেতে লাগল।