পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২১৭

 নায়েক ফরহাদ হোসেন অয়ারলেস সেট-এর পেছনে চুপি চুপি এই কথাগুলো শোনে এবং সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআরকে তা জানিয়ে দেয়। নায়েক ফরহাদ অয়ারলেস সেটে ২৭শে মার্চ আমাকে ভোর ছয়টার সময় উক্ত মেসেজ জানায় এবং বলে যে, আপনি আপনার বন্দোবস্ত করেন যদি বাঙ্গালী জোয়ানদেরকে বাঁচাতে চান।

 সেই নির্দেশ অনুযায়ী সবাইকে নিরস্ত্র করা হয়। একমাত্র সি-কোম্পানীর এক প্লাটুন ইপিআর অস্ত্র সমর্পণ করতে অস্বীকার করে। নিরস্ত্রকরণের মধ্যে সীমান্ত এলাকায় ইপিআর'রা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ঐ প্লাটুন- এর নেতা ছিল সুবেদার ফরিদউদ্দিন আহমদ।

 এই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্রবৃন্দ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা আমাদেরকে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ডাক্তার আবদুল্লা আল- মাহমুদ ও তার সহকর্মীবৃন্দ, আর ছিলেন এডভোকেট সৈয়দ আহমদ এবং তাঁর সহকর্মীবৃন্দ, অধ্যক্ষ মতিয়ুর রহমান (আলমগীর মিণ্টু কলেজ) সৈয়দ আবদুস সুলতান (বর্তমানে ইংল্যাণ্ডে হাই কমিশনার), জনাব রফিকউদ্দিন ভুইয়া, এডভোকেট মোশাররফ আকন্দ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অন্যান্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। মোজাফফর ন্যাপের অধ্যাপক আবদুল হান্নান ও অধ্যাপক দেওয়ান এবং ভাসানী সমর্থক ছাত্রনেতা আবদুল হামিদও ছিলেন।

 ২৭শে মার্চ ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস ঢাকায় নির্দেশ অনুসারে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী জেসিও - এনসিওদেরকে বাঙ্গালী ইপিআরদের খতম করার নির্দেশ দেন রাত এগারটার সময়। ট্রুপস ব্যারাক, উইং কমাণ্ডারের বাংলো এবং কোয়াটার গার্ড কোতে এবং ম্যাগজিনের সমস্ত এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ মোতায়েন করা হয়। উইং কমাণ্ডার-এর বাংলোতে সি-কোম্পানী এক প্লাটুনকে ডিউটির জন্য মোতায়েন করা হয়। গার্ড কমাণ্ডার শফি এবং অন্য দুই জনের কাছে করে ৩০৩ রাইফেল ছিল। বাকিদের কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিল না।

 রাত এগারটার সময় হেডকোয়ার্টারের তিনতলা থেকে হাবিলদার মেজর হাসিব উল্লাহ এক রাউণ্ড গুলি ফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক জায়গা থেকে ফায়ারিং শুরু হয়ে যায়। হেডকোয়ার্টারে তখন ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটা কোম্পানী আবস্থান করছিল। গোলাগুলি শুরু হবার পর বাঙ্গালী ইপিআররা ওদের সাথে মিশে যায়। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের নায়েক সুবেদার বড়ুয়া এবং সুলতান আমাদের জোয়ানদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র বাঙ্গালী ইপিআরদের দিয়ে দেয়। গোলাগুলি চলতে থাকে। ইতিমধ্যে ইপিআর-এর কিছু সাহসী বাঙ্গালী জোয়ান স্থানীয় কয়েকজন ছাত্রের সহযোগিতায় কোতে এবং ম্যাগ্যাজিন-এর ভেণ্টিলেশন ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ে অস্ত্রশস্ত্র বের করতে সমর্থ হয়। ২৮শে মার্চ ভোরবেলায় জনাব রফিকউদ্দিন ভূইয়া, শামসুল হক এমপিএ, ছাত্রনেতা আবুল হাশেম ও হামিদের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ জেল এবং পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এনে বাঙ্গালী ইপিআরদের দেয়া হয়।

 ২৮শে মার্চ বেলা ৮টা পর্যন্ত দুই পক্ষে তুমুল লড়াই চলে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৩/৯৪ জন। ১১ জন জেসিও-এসসিও জেসিও মেসে সারারাত ফায়ার করার পর ১৭ থেকে ১৯ বাক্স গুলিসহ আত্মসমর্পণ করে সুবেদার ফরিদের কাছে। ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস সকালবেলা সিপাই নান্নু মিয়া এবং আফতাব হোসেনের সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, সিপাই নান্নু এবং আফতাব স্বাধীনতা সংগ্রামে কর্ণেল নুরুজ্জামানের অধীনে এবং ডালু সেক্টরে অত্যন্ত সাহস ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে।

 ১১জন জেসিও এনসিওকে সুবেদার ফরিদউদ্দিন ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ জেলে বন্দী করা হয়। অতঃপর ময়মনসিংহের সকল বাঙ্গালী জোয়ান এনসিও মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে ৪/৬ কোম্পানী গঠন করে জয়দেবপুর ও টুঙ্গী অভিমুখে যাত্রা করে।