পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২১৮

 এদিকে রংপুর সীমান্ত এলাকার মাদারচর বিওপি থেকে সিলেট সীমন্তের মহেশখোলা বিওপি পর্যন্ত ২৪টা বিওপি'র সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআরকে (প্রত্যেক বিওপিতে তিনজন করে রেখে) দুই কোম্পানীতে সংগঠিত করে সুবেদার মেজর আবদুল হাকিম এবং আমার নেতৃত্বে মুক্তাগাছা, রসুলপুর, মধুপুর, জামালপুর, ঘাটাইল এলাকা পর্যন্ত মোতায়েন করা হয়। তখন আমাদের সঙ্গে ময়মনসিংহ শহরের শামসুল হক এমপি, মুক্তাগাছার শহীদুল্লাহ এম-পি, রফিকউদ্দিন ভুইয়া, নাগরপুর কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ন খালিদ, লতিফ সিদ্দিকী এম-পি এবং কাদের সিদ্দিকী আমাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাহায্য এবং সহযোগিতা করেন। এই সময় ময়মনসিংহ সদরের এসডিও, মেজর শফিউল্লাহর প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান এবং জনাব রফিকউদ্দিন ভুইয়া ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং ত্যাগী ও কর্নেল রাংগাজান (৮৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন কমণ্ডার)- এর সাথে যোগাযোগ করেন। সঙ্গে সঙ্গে কোন সাহায্য না দিলেও ভবিষ্যতে কর্নেল রাংগাজান আমাদেরকে সাহায্যের আশ্বাস দেন। তিনি আমাদের সামনে দিল্লীতে এ ব্যাপারে মেসেজ পাঠান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিকউদ্দিন ভুইয়া, আবদুল মান্নান (বর্তমানে পরিবার পরিকল্পানা মন্ত্রী) ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আমার কোম্পানী হেডকোয়ার্টার করইতলীতে (হালুয়াঘাটে) অবস্থান করছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে তাঁর বাড়ি থেকে জনাব আবুল হাশেম গাইড করে নিয়ে আসেন এবং আমাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাঁকে নেতা বানানো হয়। তাদেরকে কর্নেল রাংগাজানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ভারতের গাচুয়াপাড়া রেস্ট হাউস ইন্সপেকশন বাংলাতে।

 সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল প্রতিনিধি কলকাতাতে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চলে যান। সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ব্যাপারে সাহায্য ও সহযোগিতার ভার রফিকউদ্দিন ভুইয়ার উপর অর্পণ করা হয়। অন্য কোন অস্ত্রশস্ত্র না পেলেও আমরা যথেষ্ট পরিমাণ হ্যাণ্ড গ্রেনেড এবং ২৭টি এলএমজি বিএসএফ ক্যাপ্টেন ত্যাগীর নিকট থেকে পাই। তিনি ছদ্মবেশে রসুলপুর এলাকাতে আমার সাথে কাজ করতে থাকেন। এছাড়াও প্রত্যেক রাত ভারত থেকে (ডালু এবং মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে) ইণ্ডিয়ান আর্মি ইঞ্জিনিয়ার টিম পুল এবং রাস্তা ধ্বংস করার জন্য আসতেন এবং কাজ সমাধা করে রাত্রেই চলে যেতেন। ২৭শে মার্চ ময়মনসিহের উইং হেডকোয়ার্টারে পশ্চিম পাকিস্তানীদের খতম করার পর সীমান্তের সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদেরও খতম করা হয়।

 এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় কি তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের উপর কালিহাতী, রসুলপুর, মধুপুর, জামালপুর, মুক্তাগাছা, শম্ভুগঞ্জ, গৌরিপুর ইত্যদি স্থানে পাকিস্তনী বিমান বাহিনী পর্যায়ক্রমে বিমান হামলা চালায়। তাদের সৈন্যসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে এবং ক্রমশ আমাদের বাঙ্গালীদের মনোবল ভেঙ্গে যেতে থাকে বলে আমরা অনুমান করি। বিমান হামলার ফলে মেজর শফিউল্লার তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে চলে যান।

মধুপুরগড়ের যুদ্ধ[১]


 বিক্রমপুরের সুদুর গ্রামাঞ্চলে বসে ভারতীয় বেতারের প্রচারিত সংবাদ শুনছিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে আকাশবাণী ঘোষণা করছে, ময়মনসিংহ জেলার মধুপুরগড়ে পাক সৈন্যদলের আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে।

 শতাধিক বছর আগে এই মধুপুর গড় আমাদের দেশের রাজনৈতিক আবর্তনের ইতিহাসের পাতায় একটু স্থান করে নিয়েছিল। আজকের দিনে আমাদের কাছে সেই ঐতিহ্য হয়তো তুচ্ছ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু সেদিন এই মধুপুর গড়ে একদল বিদ্রোহীর অভ্যুত্থান সারা বাংলার মানুষের মনে আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিল। সেই বিদ্রোহ আকারে ছোট হলেও তখনকার দিনের বৃটিশ রাজপুরুষরা তাই নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।


  1. 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।