পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২২২

 হবিগঞ্জ শহরটি যেন আনন্দে মেতে উঠেছে।

 আমি, মানিক চৌধুরী ও জেনারেল রব একই গাড়ীতে বসেছিলাম। সবাই আমাদের হাত নেড়ে বিদায় সম্বর্ধনা জানাল। গাড়ী ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে শায়েস্তাগঞ্জের দিকে। সেদিন আমাদের গন্তব্যস্থান ছিল রশীদপুর চা-বাগান। কারণ, খবর পেয়েছিলাম পাকিস্তানীরা শ্রীমঙ্গলের ওপারে আছে। ভেবেছিলাম ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে রশীধপুর পৌঁছে যাব এবং পরদিনের কর্মসূচী তৈরী করতে পারব, কিন্তু পথে চলতে গিয়ে আমাদের অনেক বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হতে হলো। কিছুক্ষণ পর পরই রাস্তার উপরে বড় বড় গাছ, পাথর ইত্যাদি রেখে ব্যারিকেড তৈরি করা ছিল। বালা বাহুল্য, জেনারেল রব ও মানিক চৌধুরীর আদেশক্রমেই ওগুলি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে সম্পন্ন হবে তা কেউই ভাবেনি। স্বাধীনতকামী প্রত্যেকটি বাঙ্গালীর মন আজ জেগে উঠেছে। যাহোক, আমি বললাম অন্য আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত রাস্তাঘাট খোলা রাখতে। কারণ আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।

 রশীদপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় রাত ১১টা বেজেছিল। আমি জেনারেল রবকে বললাম, আজ রাত এখানেই থাকব এবং আগামীকাল ভোরে যারা আমাদের সংগে এসেছে তাদেরকে এবং তারা সংগে কি কি অস্ত্র ও হাতিয়ার এনেছে তা দেখে পরবর্তী কর্মপন্থা গ্রহন করব। রশীদপুর চা-বাগানের ম্যানেজার মোস্তাফা সাহেবকে বললাম, “আজ রাতের জন্য ওদের শ্রমিকদের সাহায্য যেন চা-বাগানটি সুরক্ষিত রাখার ব্যাবস্থা করা হয়। এবং পাকিস্তানীরা কোথায় ঘাঁটি বানিয়ে বসেছে এ খরবটি জানাবার জন্য দু-চারজন বিশ্বস্ত লোক পাঠানো হয়। এ খরবটি আমাকে কাল দুপুরের মধ্যেই দিতে হবে।”

 আমাদের সবারই আহারের ব্যবস্থা রশীদপুরেই হয়েছিল। এখানে একটা কথা বলতে চাই যে সিলেটের শমশেরনগরে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটা কোম্পানী ছিল। সেটার কমাণ্ডার ছিল মেজর খালেদ মোশাররফ (বর্তমানে কর্ণেল)। হবিগঞ্জ থেকে রওনা হয়ে যখন আমরা পাইকপাড়া আসলাম তখন জানতে পারলাম মেজর খালেদ মোশাররফ শমশেরনগর থেকে রওনা হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে যাচ্ছে। সিলেট ছেড়ে এভাবে যাবার উদ্দেশ্যটা বোঝা যাচ্ছিল না। জনারেল রবকে বললাম, আমাদের গিয়ে ওকে ধরতে হবে এবং সম্মিলিত চেষ্টায় সিলেট মুক্ত করতে হবে।

 আমরা তাড়াতাড়ি যেতে অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু পথঘাটে বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে যখন মীরপুরের পুলে এসে পৌঁছলাম তখন আমি মনে মনে চিন্তা করেছিলাম যে খালেদ মোশাররফ ও তার সৈন্যসামন্ত এবং আমার সৈন্যসামন্ত নিয়ে সিলেটকে মুক্ত করব এবং সিলেটে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে সেখানে আমাদের প্রধান হেডকোয়ার্টার তৈরি করব। সিলেট থেকে সারা বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে সুবিধা হতো। সেদিন যদি কর্নেল খালেদ মোশাররফ আমার কথা মেনে নিতেন তাহলে আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরমকভাবে লেখা হতো।

 জানতে পারলাম গত রাতেই মেজর খালেদ মোশাররফ তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে মীরপুর অতিক্রম করে চলে গেছে। মেজর খালেদ মোশাররফ ও সৈন্যসামন্তদের পেলে সিলেটকে মুক্ত করে তারপর আমরা কুমিল্লার পথে গেলে সুবিধা হত। যাইহোক ওকে যখন পেলাম না তখন আমার নিজেকেই করতে হবে।

 রাতে ঘুম হল না। চিন্তা করতে লাগলাম এ সামান্য অর্ধশিক্ষিত সৈন্য নিয়ে কিভাবে কি করব। পরদিন ভোরে বেলা প্রায় সাড়ে সাতটার সময় আমি আমার স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী ছেলেদের দেখতে গেলাম। কারণ আমাকে জানতে হবে এদের কতখানি যুদ্ধ করবার ক্ষমতা আছে এবং ওদের সঙ্গে হাতিয়ার -গোলাবারুদ কি কি আছে। আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিকরা যারা ছুটিতে ছিল সব মিলিয়ে মোট ১৫০ জন মাত্র ছিল। তাদের কাছে আছে কেবল ৩০৩ রাইফেল এবং দশ রাউণ্ড করে গুলি। এই সামান্য সৈন্য ও হাতিয়ার নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিতান্তই বোকামি।