পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২২৬

 শত্রুদের পিছু ধাওয়া করা সমীচীন মনে করলাম না, কারণ ওরা ট্রাকে করে পালিয়েছে। পায়ে হেঁটে তাদেরকে ধরা সম্ভব নয়। তাই আমার সৈন্যদেরকে সংঘবদ্ধ করতে আরম্ভ করলাম। যে যেখানে আছে ওখানেই প্রতিরোধ গড়ে রাতের জন্য বিশ্রাম করতে হুকুম দিলাম। সুবেদার ফজলুল হককে ওর কোম্পানী নিয়ে শাদীপুরের প্রায় দুই মাইল আগে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বললাম। শত্রুরা কোথায় আছে খবর দিতে আরম্ভ করলাম।

 এদিকে মৌলভীবাজারে মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে দেখা হয়। আমি তাকে বললাম যদি পারে একটা কোম্পানী পাঠিয়ে দিতে। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটা কোম্পানী আমার কাছে পৌঁছল-সিলেটের মেজর আজিজ। তাকে আমি পাঠিয়ে দিলাম কুলাউড়া-শেওলা-সাঁতারকান্দী-গোলাপগঞ্জ হয়ে সিলেটের সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এদিকে আমি শাদীপুর-সিলেটের রাস্তা শত্রুমুক্ত করে তার সঙ্গে সুরমা নদীর পারে মিলিত হব।

 ক্যাপ্টেন আজিজের সৈন্য রাস্তায় বিনা বাধায় গোলাপগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছল। কিন্তু কদমতলীর (সিলেট থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে) কাছে যখন আসল তখন শত্রুরা তার উপর গোলাগুলি ছুঁড়তে শুরু করল। যাই হোক, তার সমস্ত শক্তি দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করাতে শত্রুরা কদমতলী ছেড়ে সিলেটের দিকে পালিয়ে গেল।

 এদিকে খবর পেলাম বিশ্বনাথ এলাকায় রাস্তার দুপাশে শত্রুরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বিশ্বনাথ দখল করার প্রস্তুতি নিলাম। টুকরো টুকরো খবরে জানতে পারলাম বিশ্বনাথে শত্রুরা মাইন লাগিয়েছে এবং দুএকটা গরুও নাকি মারা গিয়েছে। এ খবরটা আমি আমার সৈন্যদের জানালাম না। যাই হোক সমস্ত শক্তি দিয়ে বিশ্বনাথের উপর আক্রমণ করলাম। এই যুদ্ধেও শত্রুরা সমস্ত শক্তি ব্যবহার করেছিল। তবে তাদের মনোবল ভেঙ্গে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে আমাদের আক্রমণে ওরা টিকতে পারল না এবং বিশ্বনাথ ছেড়ে পালিয়ে একেবারে সিলেটে চলে গেল।

 এদিকে ক্যাপ্টেন আজিজের সৈন্য শত্রুসৈন্যকে কদমতলী থেকে তাড়িয়ে সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করল।

 ৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সন। সমস্ত সিলেট জেলা আমাদের দখলে আসল।

 শত্রুরা এক জায়গায় একত্রিত হল। সিলেট বিমানবন্দর এবং লাক্কাতুরা চা-বাগানের আশেপাশে একত্রিত হয়। বুঝলাম এখন আমার কাছে যা সৈন্য আছে তা দিয়ে শত্রুদের উপর হামলা করা ঠিক হবে না, তাই জেনারেল রব ও মানিক চৌধুরীর কাছে আরো সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র চাইলাম।

 ৮ই এপ্রিল সকালে বসে আমি ও ক্যাপ্টেন আজিজ জল্পনা-কল্পনা করতে লাগলাম কি করে সিলেটকে মুক্ত করা যায়। এমন সময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর একজন লেঃ কর্নেল লিমাইয়া আসলেন এবং আমাকে বললেন শিলচরে যেতে। আমি বললাম, এক শর্তে আমি যাব যদি তিনি আমাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। তিনি বললেন, তাই হবে। আমি তখনই তাঁর সঙ্গে শিলচর রওনা হয়ে গেলাম। রাত বারটা পর্যন্ত কি কর্মপন্থা আমরা অবলম্বন করব তা ঠিকঠাক করা হল, কিন্তু সেটা কার্যকরী হবার আগেই পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ করল। ভারতীয় সৈন্য আসার সৌভাগ্য হয়নি।

 ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত পুরো সিলেট আমাদের দখলে রইল। আমার পরিকল্পনা ছিল বিমানবন্দর এবং লাক্কাতুরা চা-বাগান দখল করা। রাত প্রায় এগারটার সময় এক কোম্পানীকে পাঠিয়ে দিলাম খান চা-বাগানের দিকে। আর একটা কোম্পানীকে পাঠানো হল আখালিয়ার দিকে। আর দুই কোম্পানীকে নিয়ে লাক্কাতুরা চাবাগান দিয়ে শালুটিকর বিমানবন্দর দখলের জন্য রওনা হলাম। ক্যাপ্টেন আজিজের উপর ভার দেয়া হল সুরমা নদীর দক্ষিণ পার অবরোধ করে রাখার।