পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২২৭

 ১০ই এপ্রিল আমাদের উপর শত্রুরা প্রচণ্ড হামলা করল। শত্রুরা ইতিমধ্যে অনেক সৈন্য যোগাড় করেছিল। পুরোদিন যুদ্ধ চলল। আমাদের সৈন্যরা পাকিস্তানীদের আক্রমণের মুখে টিকতে পারল না। শত্রুরা সব রকম অস্ত্র ব্যবহার করল। আস্তে আস্তে আমার সৈন্যরা পিছু হটতে আরম্ভ করল এবং নদীর দক্ষিণ পাড়ে আসল। খাদিমনগরের কোম্পানী আসতে পারলে না। ওরা তামাবিলের (শিলং) দিকে চলে গেল। ওদেরকে আগেই বলা ছিল যদি আক্রমণ কৃতকার্য না হয় তাহলে ওরা যেন ক্যাপ্টেন মুতালিবের সঙ্গে (সে তামাবিলের দিকে যুদ্ধ করছিল) মিলে যায়।

 এসব যখন হচ্ছিল তখন আমি শিলচর থেকে অয়ারলেস যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছিলাম। তখন এক দুর্ঘটনায় আমার গাড়ী উল্টে গিয়েছিল। সেদিন খুব সম্ভব ছিল ৮ই এপ্রিল। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি গাড়ী চালাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে একজন সিগন্যালম্যান ছিল। যখন কুলাউড়ার কাছে আসি তখন দুটো লোক আমার দিকে লক্ষ্য করে অস্ত্র ধরে এবং গুলি করার চেষ্টা করে। আমি তখন গাড়ীর স্পীড বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু রাস্তা খুব পিচ্ছিল ছিল এবং গাড়ীতে স্পীডও বেশী ছিল। একটা আওয়োজ কানে আসায় পেছন দিকে তাকাতেই গাড়ীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। গাড়ী উল্টে গেল। আমার পায়ে-বুকে খুব আঘাত লেগেছিল। পরে জানা গিয়েছিল দুর্বৃত্তরা মুসলিম লীগের লোক ছিল।

 যাই হোক, খোঁড়া পা নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতে আরম্ভ করলাম। তখনই একদিন জেনারেল ওসমানী এবং ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডের সঙ্গে আমার মৌলভীবাজারে দেখা হয়। আমার এ অবস্থা দেখে লেঃ কর্নেল জামানকে সিলেট সেক্টরের ভার দেয়া হয় এবং আমাকে কিছু দিনের জন্য শেওলা-সুতারকান্দী-সিলেট এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীকালে যখন সবাই ভারতে চলে গেলাম তখন আবার সিলেট সেক্টরের পুরো দায়িত্ব আমাকে দেয়া হল। কর্নেল জামানকে উত্তর বঙ্গের একটা সেক্টরের কমাণ্ডার করে পাঠিয়ে দেয়া হল।

 যাই হোক নদীর দক্ষিণ পাড়ে ভীষণ যুদ্ধ হল। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে আপ্রাণ যুদ্ধ করে যেতে লাগল। এদের উপর বিমান হামলা পর্যন্ত হয়েছিল। শত্রুদের এই আক্রমণের মুখে টিকতে পারল না। সৈন্যরা, ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন আজিজ পায়ে গুলি লেগে আহত হল। এবং আস্তে আস্তে ওরা মৌলভীবাজারের দিকে পিছু হটতে বাধ্য হল। বাকি সৈন্যরা গোলাপগঞ্জ-ঢাকা দক্ষিণের দিকে পিছু হটতে লাগল।

 ইয়াকিনগঞ্জ-গোলাপগঞ্জে যা সৈন্য ছিল আমি প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করলাম। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি এখানে ভীষণ যুদ্ধ হয়। ইয়াকিনগঞ্জের যুদ্ধে সিলেটের বাঙ্গালী এস-পি, যিনি পাকিস্তানীদের হয়ে কাজ করতেন, আমাদের হাতে ধরা পড়েন।পাকিস্তানীদের বাঙ্গালীদের প্রতি দরদটা এই দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝা যাবে। পাকিস্তানীরা জানত না আমরা কত সৈন্য নিয়ে ইয়াকিনগঞ্জে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। আমাদের স্ট্যাণ্ডিং পেট্রল ইয়াকিনগঞ্জের প্রায় মাইলখানেক আগে ছিল। পাকিস্তানীরা সিলেটের বাঙ্গালী এসপি সাহেবকে গোলাপগঞ্জে একটা অজুহাতে পাঠিয়েছিলেন। ইয়ার্কিনগঞ্জ-সিলেট সড়কে লোক চলাচল একেবারে বন্ধ ছিল। শত্রুরা জানত যে সিলেট থেকে যদি কেউ গোলাপগঞ্জের দিকে যায় তাহলে তার রক্ষা নেই। ফায়ার খুললে একটি বাঙ্গালী মরলে ওদের কিছু যায় আসে না। ওদের যা জানার দরকার তা জানতে পারলেই হল। এসপি সাহেব স্ট্যাণ্ডিং পেট্রল পার হয়ে যখন মূল ডিফেন্সের মধ্যে আসল আমাদের ফায়ার খোলা হল চারিদিক থেকে। তার জীপ দাঁড়িয়ে গেল। দেখালেন রুমাল। ফায়ার বন্ধ করে আমরা কয়েকজন গেলাম, ভাবলাম বড় শিকার পাব। কিন্তু আশ্চর্য! বাঙ্গালী এসপি, কি করব, গুলি করে মারতে মনটা চাইল না। নিয়ে আসলাম ধরে। কত কাকুতিমিনতি করে বললাম, মশাই, পাকিস্তানীদের পা চাটছেন। ধরা পড়েছেন। তবে প্রাণে মারব না, কারণে আপনি বাঙ্গালী। হুকুম দিলাম ওকে আমার হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেতে। ওকে জেনারেল ওসমানী সাহেবের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠিয়ে দিই। ওর গাড়ীটা অবশ্য আমাদের লেগেছিল। আশ্চর্য, পরের দিনই রাতে শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ করল।