পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৪১

সেখানটায় উপস্থিত ছিলেন। নাপাম বোমার নিক্ষেপ থেকে শুরু করে টারগেট হিট, আগুন ধরা সবকিছুর জীবন্ত ছবি উঠে গেলো তাদের ক্যামেরায়। ওরা এত নির্ভীক যে ত্রস্ত গতিতে গাছের উপর উঠেও তারা এই আকাশ ও জমিনের যুদ্ধের ছবি তোলা পরিচালনা করেন।

 এই যুদ্ধে আমাদের বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি, শুধু একজন স্বেচ্ছাসেবক গায়ে বোমার সামান্য একটা টুকরা লেগে সামান্য আহত হয়। তবে চুয়াডাঙ্গা শহরের ঠিক দক্ষিণ ভাগে একটা বাড়ীর কুঁড়েঘরে নাপাম বোমা নিক্ষিপ্ত হলে সে ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এত সুষ্ঠুভাবে এত সাহসের সহিত টিভির সদস্যরা এই জীবন্ত ছবি তোলার কাজ সমাপন করেন যে তাদেরকে আমি সালাম না জানিয়ে পারিনি।

 আমার মনে আছে, এই মুভি রীলের মধ্যে আমি জোর দিয়ে একটা কথা পরিষ্কারভাবে বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চেয়েছি যে, আমরা পৃথিবীর স্বাধীন দেশগুলোর শুধু নৈতিক সমর্থন চাই, বস্তুগত সমর্থনের দরকার আমাদের নেই, কারণ আমার হাতের চীনা এসএমজিটা দেখিয়ে ওদেরকে শত্রুর অস্ত্র দিয়েই আমরা শত্রুকে হনন করবো।

 পরিশেষে এই টিভি সদস্যদল আমাদের কাছে বিদায় গ্রহণ করে কলিকাতা যান। বলে গেলেন যে, তারা প্যারিসে সেদিনই চলে যাবেন এই এ্যাকশন ফিল্মের পাবলিসিটি দেবার জন্য।

 পরবর্তীকালে এই সদস্যদলের দ্বিতীয়বার আগমনে জানতে পারলাম, তাঁরা নাকি এই ফিল্মের কপি আরও ৫১টি বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করেছে। আরো জানতে ও শুনতে পেলাম নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালকের মাস্টার পিস ফিল্ম প্রোডাকশনের মত এই যুদ্ধের ফিল্মটিও সারা বিশ্বে সুপারহিট করেছিল, কারণ এটাই সে পর্যন্ত বহির্বিশ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও প্রতিজ্ঞা সাফল্যজনকভাবে বিশ্বের স্বাধীনচেতা লোকদের মনোযোগ ও সমর্থন আকর্ষণ করতে পেরেছিল। লণ্ডন, ওয়াশিংটন ও অন্যান্য জায়গা থেকে সামরিক ও বেসামরিক অফিসাররাও এই সত্যের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

 ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর কাছ থেকে কিছু কিছু ৩০৩ রাইফেল, ২/১টা এলএমজি, কিছু স্টেনগান ও সামান্য পরিমাণ গোলাবারুদ পেয়েছিলাম। অনেকে ভারত থেকে আমার কাছে এসেছিলেন দেখা করতে সামান্য কিছু রিলিফ সামগ্রী নিয়ে। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির খ্যাতনামা সেক্রেটারী শ্রী এম, কে, ভিমানী এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এসে আমার কাছ থেকে আমার কি কি প্রয়োজন তার একটা ফর্দ করে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ঐ ফর্দের কোন জিনিসই কোনকালে পেলাম না, তাদেরও আর সাক্ষাৎ পেলাম না। অবশ্য শ্রী ভিমানী আমার সৈন্যদের যে পরিমানে রিলিফ সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন, তাতে যুদ্ধক্ষেত্রে বুট, কাপড়, ঔষধপত্র থেকে আরম্ভ করে ওদের কোন কিছুরই অভাব হয়নি।

ভারতের সাথে যোগাযোগ

 ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১ সন, সময় সকাল ১০টা। সীমান্তবর্তী জীবননগর থানা থেকে খবর আসল আমার সদর দপ্তরে যে, মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ভারতীয় কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার আমার সাথে দেখা করার জন্য জীবননগর সীমান্তে অবস্থান করছেন। যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে আমার সেখানে যাওয়া উচিত। একটি জীপে চড়ে ২জন সৈনিক সাথে করে রওনা হলাম। সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মাটিতে পা দিতেই লেঃ কর্নেল এইচ, আর, চক্রবর্তী (সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ৭৬ নং ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার, কৃষ্ণনগর) আমাকে জোর আলিঙ্গন করে গ্রহণ করেন ও আমার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেখানে দেখা হয় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর আই-জি সাহেবের সাথে। মনোযোগ সহকারে তাঁরা শুনলেন আমার রণাঙ্গনের আদ্যোপান্ত ইতিহাস। শুনতে চাইলেন আমার যশোর আক্রমণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আরও শুনতে চাইলেন ঐ পরিকল্পনাকে সার্থক করতে হলে আমার কি কি প্রয়োজন। বললাম সবকিছু। তাজউদ্দীন সাহেব আশ্বাস দিলেন