পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৪৭

৬ টায় একটা ১ টন ডজ গাড়ীতে করে ৩ ইঞ্চি মর্টারগুলো পাঠিয়ে দিই তাদের সাহায্যার্থে। তার কিছুটা অগ্রসর হয়ে সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নিয়ে শত্রুর উপর মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এমন সময় শত্রুর আক্রমণের চাপে আমার ভাইটাল পজিশন থেকে এমজিওয়ালা তার এমজি সহকারে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু ঠিক সে সময় পূর্বতন হাবিলদার মেজর তখনকার নায়েক সুবেদার মুজিবল হক সেখানে উপস্থিত হয় এবং তার কাছ থেকে এমজি ছিনিয়ে নিয়ে ঐ ভাইটাল পজিশন তেকে ক্ষিপ্র গতিতে অগ্রগামী শত্রুর উপর সুইপিং ফায়ার চালাতে থাকে। সুবিধা ছিল এই যে শত্রুর অবস্থান ছিল তখন খোলা এবং নিচু জায়গায়। মুজিবুল হকের এই তীব্র আক্রমণে শত্রুপক্ষের অধিকাংশ সৈন্য ধরাশায়ী হয় এবং তাদের আক্রমণ প্রায় ব্যর্থ হবার উপক্রম হয়।

 ওদিকে পাকিস্তান বাহিনীর দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন আমার ডানদিকের কোম্পানীন উপর আক্রমণ চালায় সকাল ৬ টায়। তারা এসেছিল ইপিআর পোশাক পরে। কাজেই, প্রথমতঃ আমার ইপিআর বাহিনী ধোঁকা খেয়ে যায় কিন্তু পরক্ষনেই তারা এই চালাকি বুঝতে পেরে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তীব্র প্রচেষ্টা চালায়। ওদিকে মুজিবল হকের একক অথচ তীব্র এমজি'র সুইপিং ফায়ারে যখন শত্রুসৈন্য বিধ্বস্ত প্রায়, তখনই ডানদিক থেকে ইপিআর পোশাকের বেশে ১ প্লাটুন শত্রুসৈন্য তার দিকে অগ্রসর হয়। মুজিবল হক তাদেরকে দেখতে পেয়েও ইপিআর বাহিনী ভ্রমে তাদের উপর ফায়ার করেনি। এটাই হল তার ও আমাদের চরম দুর্ভাগ্য। প্রকৃত এম-জি ম্যান ল্যান্স-নায়েক বার বার মুজিবল হককে হুঁশিয়ার করা সত্ত্বেও সে ইপিআর বাহিনী বলে শত্রুর উপর ফায়ার করতে অস্বীকার করে কিন্তু মিনিট পরেই এই ইপিআর-বেশী শত্রুপ্লাটুন তার উপর হামলা চালায়। শত্রুর এল-এম-জি'র বুলেট মুজিবল হকের বক্ষ ভেদ করে তক্ষণই তার জীবন শেষ করে দেয় (ইন্না....রাজেউন)। এল-এম-জি ম্যান হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। নায়েক সুবেদার মুজিবল হকের অপরিসীম সাহস, কৃতিত্ব ও আত্মত্যাগের ঋণ বাংলার জনসাধারণ কোনকালেই শোধ করতে পারবে না। প্রতক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, মুজিবল হকের এম-জি সহকারে তীব্র যুদ্ধে আনুমানিক ১৫০ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়, যার জন্য সাময়িকভাবে শত্রুর আক্রমন প্রতিহত হয়। ইত্যবসরে, আমার বামদিকের কোম্পানী মুজিবল হকের ফায়ারের আড়ালে থেকে সীমান্তবর্তী এলাকায় পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হয়। ওদিকে ডানদিকের কোম্পানীও সাপোর্ট ফায়ারের অভাবে ক্ষণিক যুদ্ধের পর সীমান্তবর্তী এলাকায় অপসারণ হয়। দুঃখের বিষয়, মুজিবল হকের পতনের সাথে সাথেই আমার মর্টার বাহিনী মর্টার গুটিয়ে গাড়ীতে করে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে কিন্তু অল্প দূরে শত্রুসৈন্যের অবস্থান লক্ষ্য করে ড্রাইভার গাড়ী দাঁড় করিয়ে রাস্তার আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে পালিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে মর্টার বাহিনীর কমাণ্ডার মোমিনুল হককেও একই পদ্ধতিতে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। গাড়ী ও মর্টার শত্রুর হস্তগত হয়।

 এদিকে সীমান্ত এলাকাকে আমার বাহিণী প্রাণপণে শত্রুর মোকাবিলা করতে থাকে। সমস্ত দিন গোলাগুলির পরেও শত্রুসেনারা আমার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে পারেনি। এবং আমার সদর দপ্তরে উড্ডয়নরত বাংলার জাতীয় পতাকার পতপত ধ্বনিকে শত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা কোন দিন স্তব্ধ করতে পারেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত ঐ পতাকা উড্ডয়নরত থাকে।

চুয়াডাঙ্গা-কুষ্ঠিয়া প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ মেজর এ, আর, আজম চৌধুরী

২৬-৩-৭৩

 আমি তখন চুয়াডাঙ্গা ইপিআর ৪ নং উইং-এ একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করছি। ২৩শে মার্চ আমাদের সীমান্ত পরিদর্শনে যাই। ফিরি ২৫ শে মার্চ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে। মেজর ওসমান চৌধুরী ২৫ শে মার্চ কুষ্ঠিয়া গিয়েছিলেন, ২৬ শে মার্চ বেলা ১২ টার দিকে চুয়াডাঙ্গাতে আসেন।