পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৫২

 আমাদের বৈঠক এক ঘণ্টাকাল স্থায়ী হয়। আপ্যায়নের মাধ্যমে মিঃ মূখার্জী আমাকে জানান যে, আমার চিঠির উত্তরে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া আমাকে শীঘ্রই জানানো হবে এবং তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশের অপেক্ষা করছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাদের সংগ্রামে ভারতের জনগণের ও সরকারের সমর্থন জানান এবং চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে চেংখালী চেক পোস্টের অদূরে ভারতীয় বিওপিতে কোন একজন সামরিক অফিসারকে সাথে নিয়ে দেখা করি আমাদের সামরিক প্রয়োজন সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করার জন্য। ইতিমধ্যে চুয়াডাঙ্গায় তদানীনতন ইপিআর এর উইং কমাণ্ডার মেজর ওসমানের সাথে আমার যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

 ৩০শে মার্চ সকালে মেহেরপুর থেকে ১৮ মাইল দূরে চুয়ায়াডাঙ্গায় মেজর ওসমানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করতে যাই। চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান কুষ্টিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় তিনি পরামর্শ দেন যে আমি মাহবুবউদ্দিন আহম্মদ (তদানীন্তন ঝিনাইদহের এসডিপিও)-কে সাথে নিয়ে যাই। আমি মাহবুবকে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু অল্প সময় পরে হঠাৎ সে মেজর ওসমানের চুয়াডাঙ্গা অফিসে আবির্ভূত হয়। মাহবুবকে আমি ভারতীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করি এবং তাকে বলি ঐ দিন সন্ধ্যায় ভারতের চেংখালী চেকপোস্ট বিপওপিতে কিছু সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিতে আমার সাথে আসতে এবং এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সাথে বিশদ আলোচনা করতে। আমি তখন অত্যাধিক উত্তেজিত ছিলাম। আমি লক্ষ্য করলাম মাহবুবও কম উত্তেজিত ছিল না। কারণ একটু পরে বুঝতে পারলাম মাহবুব আমাকে অদূরবর্তী একটি জীপের কাছে নিয়ে চলল এবং খুব গোপনে বলল (মেজর ওসমান ও এ ঘটনা সম্বন্ধে তখন অবহিত ছিলেন না) যে, ঐ জীপের বিতরে ২ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বসে আছেন এবং তারা হচ্ছেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম (বর্তমান খাদ্য প্রতিমন্ত্রী)। আমরা দু'জনে জীপের ভেতরে প্রবেশ করলাম। শার্ট এবং লুঙ্গি পরিহিত এবং পুঁটুলি হাতে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত এই দুই ব্যক্তিই অবশ্য পরে বাংলাদেশের স্বধীনতা সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

 আলাপ-আলোচনার পর বুঝতে পারলাম তাঁরা বিভিন্ন জনপদ ঘুরে ঝিনাইদহে এসেছেন এবং সেখান থেকে মাহবুব তাদেরকে মেহেরপুরে নিয়ে আসে এই উদ্দেশ্যে যে, তাদেরকে যেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছানো যায়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা এবং সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং আক্রমণকে পরাভূত করে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য বন্দু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাহায্য এবং সহযোগিতার ব্যবস্থা করা। সত্যি বলতে কি, তাঁদের এই বৃহত্তর প্রচেষ্টার তাৎপর্য আমি তখনো উপলব্ধি করতে পারিনি। সিদ্দঅন্ত হল যে, ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৈঠকে মিলিত হব। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সীমান্তের অপর দিকে যাবার ব্যবস্থা করা হবে। শর্ত হল একটা, আমরা যাদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তাদের কাছে এই দুই জনের পরিচয় গোপন রাখব। তারা জানতে চাইলে আমরা বলব, এই দুই ব্যক্তি আমাদের পরিচিত।

 বিকালে সীমান্তের উদ্দেশ্যে দুটো জীপ রওয়ানা দেয়। পথে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমরা ব্যারিকেড সরিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম। আমাদের গাড়ীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। রাস্তার দু'পাশে জনতা মুহুর্মুহু জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আমাদেরকে সম্বর্ধনা জানাচ্ছিল। এই দুটো জীপ গাড়ী যেন তাদের কাছে স্বাধীনতার শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। এরা অনেকেই আমাদেরকে চিনত। গ্রামবাসীরা বুঝতে পেরেছিল যে আমরা কোন গোপন মহৎ সামরিক উদ্দেশ্যে সীমান্তে ঘোরাফেরা করছি। পথে পথে দেখতে পেলাম স্বতঃস্ফূর্ত জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলছিল, অস্ত্র বলতে হয়ত একটা দুটো শর্টগান। তখনই এদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াস, এবং আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে