পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৫৩

ভবিষ্যত প্রস্তুতি, সামরিক প্রতিরোধ এবং সংঘর্ষে জনশক্তি এবং এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অথচ দলবদ্ধ জনতাই জোগাবে।

 সন্ধ্যার পরে পরে আমরা চেংখালী চেকপোস্ট পৌঁছালাম। বড় বড় শিরিষ গাছের সারি দু'পাশ থেকে রাস্তার উপরে একটা ছাতার মত আবরণ সৃষ্টি করেছিল। কোন লোকালয় জনপদ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না, চারদিক পরিবেশ ধু-ধু খাঁ খাঁ করছিল। শুক্লপক্ষের ম্লান চাঁদের আলো পরিবেশকে আরো গভীরতর করে তুলেছিল। পিছনে গাড়ী দুটো রেখে আমি এবং মাহবুব ধীরে এবং সতর্কতার সাথে অপরিচিত গন্তব্যস্থানের দিকে আন্তাজের উপর ভর করে এগুচ্ছিলাম। বারবার আমাদের গায়ের লোম শিউরে উঠছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা চলার পর সামনে একটা পাকা ঘরের ধ্বংসস্তুপ দেখতে পেলাম, আমরা বুঝতে পারছিলাম না আমরা কোথায় যাচ্ছি। হঠাৎ সেই ভুতুরে ধ্বংসস্তুপ থেকে যেন এক অশরীরী আত্মার আওয়াজ শুনতে পেলাম-‘হলট’। যদিও আমরা একটু ভড়কে গিয়েছিলাম তবুও অনতিবিলম্বে ঝোপের আড়াল থেকে একটা মানুষের ছায়া বের হয়ে আসল। এবং সেটা ছিল ভারতীয় বিএসএফ-এর একজন সিপাহী, আমাদের পরিচয় দেবার পর সে আমাদেরকে তাদের বিওপিতে নিয়ে চলল। আরো আধা মাইল চলার পর আমরা বিওপিতে পৌঁছালাম এবং আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন বিএসএফ-এর উচ্চপদস্থ কর্মচালী জনাব গোলাম মজুমদার এবং লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল চক্রবর্তী। আনুষংগিক আলোচনার পর দুটো সিদ্ধান্ত নেয়া হলঃ ১। আমাদেরকে আগামীকাল থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে এবং ২। ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে আওয়ামী লাগের রাজনীতিবিদের যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে এবং যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালাতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে যোগাযোগ করার। তখনো তারা জানতেন না যে আমাদের সাথে জনাব তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম রয়েছেন।

 আমি এবং মাহবুব নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করলাম যে, আমাদের সাথে যে তাজউদ্দিন রয়েছেন তা গোলক মজুমদারকে জানাব এবং গোলাম মজুমদারকে জানালাম। গোলক মজুমদার আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাড়াতাড়ি কাজউদ্দিন সাহেবকে তার কাছে নিয়ে আসতে বললেন। আমরা তাজউদ্দি কে তার কাছে নিয়ে আসলাম। তারা একে অপরকে আন্তরিকভাবে করমর্দন এবং আলিঙ্গন করলেন। গোলক মজুমদার আমাদেরকে বলেছিলেন যে, কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে একটি সামরিক জেট বিমান অপেক্ষা করছে। যদি কোন রাজনীতিবিদ আসে তাকে যেন তক্ষুণি দিল্লীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হয়ত ঐ প্লেনেই জনাব তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম দিল্লীতে গিয়েছিলেন।

 রাতে আমরা এক সাথে খাবার খাই। গোলক মজুমদার, তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে নিয়ে যান। এবং চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে যাত্রা করি।

 এই রাতে সাক্ষাৎকারের পর থেকে ভারত থেকে আমরা কমবেশী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং জ্বালানি পেতে থাকি। আমি নিজে প্রায় এক পক্ষকাল ধরে এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ভারত থেকে নিয়ে আসতাম। এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র চেংখালী চেকপোস্টের বিপরীত দিকে ভারতীয় বিওপি থেকে নিয়ে আসতাম। আমি প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় ভারত সীমান্ত অভিমুখে চুয়াডাঙ্গা থেকে যাত্রা করতাম। সাথে থাকত ইপিআর এর দুটো এসকর্ট পেট্রল, কয়েকটা ট্রাক এবং কোন কোন সময় দর্শনা চিনিকলের ট্রাক্টর এবং তার সাথে লাগানো ট্রলী। এই অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করার সময় আমি ভারতীয় কাগজপত্রে দস্তখত করে নিতাম এবং মেহেরপুরের এসডিও-র সরকারী সীলমোহর ব্যবহার করতাম।

 মধ্যরাত্রের দিকে আমরা ভারতীয় বিওপিতে পৌঁছাতাম এবং চুয়াডাঙ্গায় ফেরত আসতে আসতে অধিকাংশ সময়েই ভোর হয়ে যেত। এই সময় এক নাগাড়ে আমি দশ দিন বিছানায় গা লাগাতে পারিনি। অস্ত্রশস্ত্র দেবার সময় অনেক সময় কর্নেল চক্রবর্তী থাকতেন এবং সব সময় ক্যাপ্টেন মহাপাত্র থাকতেন।