পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৫৭

ব্যবস্থা চালাচ্ছিলাম। আমি এই সময় মেহেরপুরের প্রশাসন ভার মেহেরপুরের সেকেণ্ড অফিসারকে দিই এবং নিজে সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সামরিক অফিসারের ভূমিকা গ্রহণ করি।

 এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই সময় শত শত ভারতীয় এবং বিদেশী সাংবাদিক, টেলিভিশন সংস্থা আমাদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং এই মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করে। তাদের সবারই একই প্রশ্ন ছিল যে, তোমাদের সরকার কোথায়?

 আমরা উত্তরে জানাই যে, অতিশীঘ্রই আমাদের বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হবে। এই সময় আমরা ভারতের টুংগী বিওপি'তে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাত্ত করি এবং সমগ্র পরিস্থিতির পর্যালোচনা করি। তাঁরা আশ্বাস দেন যে অতি শীঘ্রই সরকার ঘোষণা করা হবে।

 এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ও শেষদিক থেকে যুদ্ধ একটি নতুন মোর নেয়। এই সময় শত্রুসৈন্য যশোর সেনা নিবাসে নতুন ভাবে সমর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আমার অভিমত যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি যে বাঙ্গালীরা তাদের সুশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিতে পারে। কুষ্টিয়ার গ্লানি নিশ্চয়ই তাদের মনোবল ভেংগে দিয়েছিল। তাই প্রচুর রিইনফোর্সমেণ্ট ঢাকা থেকে যশোর আনা শুরু হয়। আমরাও ঊর্ধ্বশ্বাসে তাদের নতুন তৎপরতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা একসময় ভাবছিলাম যে জনতার সমুদ্র নিয়ে যশোর সেনানিবাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। যশোর সেনানিবাস তখন আমাদের কাছে বাস্তিলের কারাগারের মত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটির প্রতীক মনে হচ্ছিল। কিন্তু লক্ষ লক্ষ জনতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার একটা ঝুঁকি ছিল যে হয়ত যশোর আমরা দখল করতে পারব কিন্তু তা হবে হাজার হাজার লোকের প্রাণের বিনিময়ে। এতবড় একটা ঝুঁকি নিতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।

 এই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের প্রথম সংঘর্ষ হয় বিশাখালীতে। এইখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্যের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এটা ছিল এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে। আমাদের ইপিআর বাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই আক্রমণ মোকাবিলা করে। হানাদার বাহিনীর শতাধিক সৈন্য হতাহত হয়। প্রায় ২৪ ঘণ্টার এই আক্রমণ প্রতিহত করার পর আমরা বিশাখালী থেকে প্রতিরক্ষা বুহ্য পিছিয়ে আনতে বাধ্য হই। এই প্রথম ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট আমাদের মনোবলের উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই প্রথম আমরা উপলদ্ধি করি যে শত্রুর দূরপাল্লার ভারী কামানের জবাব দেবার মত অস্ত্র আমাদের ছিল না। অন্যদিকে শত্রু এই কামানের আক্রমণ দ্বারা আমাদেরকে পিডাউন করে রেখে সেই আর্টিলারী কভারের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর তাদের সুবিধা অনুযায়ী আক্রমণ চালাতে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক আক্রমণে তারা প্রচুর সৈন্য ব্যবহার করছিল। প্রত্যেক আক্রমনের সাথে আমাদের মনোবলও ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং আমরা ভবিষ্যৎ বিজয়ের কোন সামরিক সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তদুপরি আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছিল না এবং কোন রণাঙ্গণে অগ্রবর্তী অথবা পশ্চাদবর্তী অবস্থানগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তাতে যুদ্ধ দক্ষতা এবং মনোবলের উপর যে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তা যারা যুদ্ধে অভিজ্ঞ তারাই বলতে পারবে। এই রকম একটি অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে আমি নিজেও অসহায় অবস্থায় পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হই। তদুপরি এই সময় বর্ষার অশুভ আগমন শুরু হয়। আমাদের অবস্থানগুলোতে খাদ্যদ্রব্য এবং গোলাবারুদের অভাব দেখা দেয়। বিচ্ছিন্ন অবস্থানগুলোতে এই বিরুপ পরিস্থিতিতে সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যেতে শুরু করে। আমাদের পশ্চাদপসরণ অব্যহত থাকে। এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসারও কোন সুব্যবস্থা ছিল না। ঔষধের অভাবে অনেকেই মারা যায়। এটা সহযেই অনুধাবনযোগ্য যে গোয়ালন্দের মত জায়গায় ক্ষুদ্র একটি প্রতিরক্ষাবৃহৎ কি রকম আত্মঘাতী ছিল। এদের পেছনে পাক ছত্রীসৈন্য অবতরণ করে অনায়াসে ঐ ঘাঁটিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়। একইভাবে নগরবাড়ী ঘাট এবং অবশেষে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ শত্রুর আয়ত্তে চলে যায়। আমাদের খবর অনুযায়ী জেনারেল মিঠা খান পাবনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এ্যাসিক্স-এর অপারেশন চালান।