পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৫৯

বজায় রাখা এবং ভারতীয় এলাকা থেকে বিদেশী সাংবাদিকরা যাতে সহজে আসতে পারেন এবং শত্রুর সম্ভাব্য বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ছদ্মাবরণের ব্যবস্থা করা।

 ১৬ই এপ্রিল মাহাবুব (ঝিনাইদহ মহকুমা পুলিশ অফিসার ছিলেন, পরে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একজন অফিসার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন) ও আমি চুড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানের দিকে যাত্রা করি। তখন ছিল অত্যন্ত সংকটময় সময়। তখন আমরা আমাদের বাহিনীর পশ্চাদপসরণের খবর পাচ্ছি। অগ্রবর্তী এলাকার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আমাদের সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর ওসমান তখন আমাদের বাহিনীর প্রধান। তিনি তাঁর সদর ঘাঁটি মেহেরপুরে সরিয়ে এনেছেন। মেজর ওসমান ভীষণ ব্যস্ত এবং চিন্তান্বিত। পাকিস্তান বাহিনী একের পর এক আমাদের প্রতিরক্ষাবৃহ্য ভেদ করে এগিয়ে আসছে। আমরা তখনো জানতাম না আর কতদিন মাতৃভূমির বুকে আমাদের শেষ ঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে পারবো। আমরা দুপুর নাগাদ আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম। একটা সাধারণ মঞ্চ তৈরী হচ্ছে, বাঁশ দিয়ে ঘেরা। এলাকাটি সীমান্ত ঘেঁষা বলে আমরা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ৭৬তম ব্যাটালিয়নের লেঃ কর্নেল চক্রবর্তীর সাথে এই উপলক্ষে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করছিলাম।

 ১৭ই এপ্রিল আমি আর মাহাবুব সেই ঐতিহাসিক স্থানে ছুটলাম। অনাড়ম্বর আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যদের সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। আমি তাঁদের নিয়ে এলাম বদ্যনাথতলার মণ্ডপে। ওখানে আশেপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারের মধ্যে সবগুলি পূর্নাঙ্গ নয়। কোনটার একটা হাতল নেই, কোনটার একটা পায়া খোয়া গিয়েছে। মণ্ডপ পাহারা দেবার জন্য নিয়োজিত আনসারদের জন্য কিছু রান্না হয়েছিল। মাহাবুব আর আমি দ্রুত একটা অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়ন করে ফেললাম। অন্যদেরও তা দেখালাম। আমরা নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার দেবার মত কয়েক প্লাটুন ইপিআর ও মুজাহিদ মোতায়েন করি। মাহাবুব তাদের নিয়ে গার্ড অব অনার দেবার মহড়া শুরু করলো। আমি তখন কর্নেল ওসমানী ও অন্যদের সাথে কয়েকটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। হাজার দুয়েক লোক জমায়েত হয়েছে অনুষ্ঠানে। তার মধ্যে অন্ততঃ শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান।

 নীরব আম্রকুঞ্জ। সমবেত গ্রামের মানুষের নিকট অতীতেও এমন কোন অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়নি। আমরাও অনুষ্ঠানের কথা গোপন করে রেখেছিলাম। গ্রামের মানুষের শূন্যদৃষ্টির ভাষা আমরা বুঝতে পেরেছি। তারা যেন এক অঘটন ঘটতে দেখেছে- বিস্ময়াবিষ্ট, নিষ্পলক।

 বেলা ১১টা নাগাদ বহুপ্রতীক্ষিত অনুষ্ঠানের সূচনা হল। আমি জীপে করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এমএজি ওসমানী ও অনান্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তোরণের কাছে নিয়ে এলাম। মাহাবুব গার্ড অব অনারের নেতৃত্ব দিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করলেন। পিছনে দাড়িয়ে জেনারেল ওসমানী। সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন পতাকা উত্তোলন করছিলেন তখন সাংবাদিকরা তাদের চতুর্দিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটা ছোট দল জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” গাইলো। একটা জাতির জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করলাম। এমন জন্মের কাহিনী ইতিহাসে বহুবার পড়েছি। কিন্তু বিশ্বাস হয় না চোখের সম্মুখে একটি জাতি জীবনের স্পন্দনে স্পন্দিত হচ্ছে। গার্ড অব অনারের পর ভাবী মন্ত্রিসভার সদস্যরা মঞ্চে উপবেশন করলেন। সৈয়দ নজরুল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন। তারপর এক এক করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণ দান করলেন। রাষ্ট্রপতির পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। ঘোষণা করা হল, লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের নীচে পাকিস্তান সমাধিস্থ হয়েছে। আর এই সমাধির উপরে একটি জাতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেই জাতি হলো বাংলাদেশ। মানুষ এই ঘোষণাকে অভিনন্দিত করলো।