পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৬০

আমাদের মধ্যে কয়েকজন সম্মেলন কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ তার সহযোদ্ধারা প্রতিরক্ষাবূহ্য রচনা করে বসে রয়েছেন। মাহাবুব আর আমি চললাম আমাদের কর্মক্ষেত্রে। পথে আমরা উপলব্ধি করলাম, একটি জাতি আজ জন্ম নিল বটে কিন্তু আজ যে শিশু জন্ম নিল সেই শিশুকে বিশ্ব সভায় আসন গ্রহণের জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমরা জানি এই পথ পাড়ি দেবার জন্য আরও রক্তমূল্য দিতে হবে। আমাদের কাহিনী রক্তাক্ষরে লিখতে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের চিন্তা হলো, সদ্যোজাত জাতি বড় হবে যেদিন, যেদিন বিশ্বসভায় মর্যাদার আসন পাবে, সেদিন কি আমরা তা আজকের মত দেখার জন্য বেঁচে থাকবো?

 সরকার গঠনের পর আমাদের সাথে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একত্রীকরণ হয়। মেজর ওসমানের নেতৃত্বাধীনে আমাদের সৈন্য শার্শা-নাবারন এলাকায় মোতায়েন করা হয়। এই সময় উল্লেখযোগ্য যে, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন এবং ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজ ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে মেহেরপুরে এসেছিলেন তারাও এপ্রিলের আনুমানিক দশ তারিখে চুয়াডাঙ্গায় আমাদের সথে যুদ্ধে যোগ দেন। এই সময় আরো দুজন সামরিক অফিসার আমাদের সাথে যোগ দেন। তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন হুদা, যিনি পাবনা থেকে পিছু হটে আমাদের সাথে যোগ দেন। আর অন্যজন ছিলেন ক্যাপ্টেন ওহাব। যিনি যশোহর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসেন। শার্শা নাভারনের নতুন প্রতিরক্ষাবূহ্যকে আমরা শক্তিশালী করতে থাকি। এই সময় আমরা আর একজন নতুন মুক্তিযোদ্ধাকে পাই, যাকে পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনীতে নেয়া হয়। তার সাথে পরিচয় হয়। তিনি সরাসরিভাবে প্রতিরক্ষাবৄহাতে মোতায়েন ছিলেন। তিনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ। তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ছিলেন।

 এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে এই সময়েই ক্যাপ্টেন হাফিজ নাভারনে শত্রুবাহিনীর ঘাঁটির উপর একটা সাফল্যজনক দঃসাহসিক রেইড চালান। এই রেইডে প্রথম বেঙ্গলের লোকজন ছিল। এতে করে যদিও শত্রুর কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয় তবুও তারা আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে। এবং তারপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরাট আকারে আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে শত্রুবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিয়েছিল, যার প্রত্যুত্তরে আমাদের কিছুই ছিল না। তাই আক্রমণকারী বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করে আমরা পিছু হটতে থাকি। এই সময় হাবিলদার মেজর মুজিবুর রহমান সহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে শহীদ হন। অনেকেই হতাহত হন। আমরা পরে জেনেছিলাম শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি হতাহত মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক ছিল। সেই এলাকায় এক মৃত মেজরের নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক ছোট মেমোরিয়াল তৈরী করেছিল।

 আমাদের পশ্চাদপসরণ বিশৃঙ্খলভাবে হয়েছিল। পশ্চাদপসণের সময় কিছু মূল্যবান হাতিয়ার খোয়া যায়। বেনাপোল চেক পোষ্টে আমাদের দফতর স্থানান্তরিত করা হয়। ঐদিন জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বৃটিশ এমপি টমাসম্যানসহ চেকপোষ্টে আসেন এবং ঐখানে তার বিবৃতি দেন। ঐদিন পরে শত্রুবাহিনী আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপরে গুলীবর্ষণ করে। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য আমরা মোটেও তৈরী ছিলাম না-শত্রুর আক্রমণে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং বাংলাদেশের মাটিতে শেষ ঘাঁটিটুকু ছেড়ে দিয়ে ভারতে পশ্চাদপসরণ করি।

কুষ্টিয়ার যুদ্ধ

 কুষ্টিয়াতে ২৮শে মার্চ সকালে কারফিউ উঠাতেই জনসাধারণ পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৩০শে মার্চ সকালে পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা অসামরিক লোকজনদের সহায়তায় কুষ্টিয়া শহরে অবস্থানরত ২৭তম বালুচ রেজিমেণ্টের ওপর আক্রমণ চালিয়ে অবস্থানটি দখল করে নেয়।

[১]


  1. “লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' গ্রন্থ থেকে সংকলিত।