পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৬১

 চুয়াডাঙ্গাস্থ ৪র্থ ইপিআর উইংয়ের উইং কমাণ্ডার মেজর ওসমান সরকারী কাজে কুষ্টিয়া গিয়ে সার্কিট হাউসে উঠেছিলেন। পাকিস্তনীদের হামলার সময় তিনি কোন প্রকারে কুষ্টিয়া থেকে আত্মরক্ষা করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। ২৬মে মার্চ বেলা ১টার দিকে তিনি চুয়াডাঙ্গা পৌঁছে ইপিআর সেনাদের সংগঠিত করেন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। ৪র্থ উইংয়ের সদর দফতর থেকে ওয়ারলেসে ঐ এলাকার সীমান্তবর্তী সকল ফাঁড়ির ইপিআর সদস্যদের জনগণের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দেয়া হয়। ২৭শে মার্চ সকালে মেজর ওসমান ১ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বাঙ্গালী কমাণ্ডিং অফিসার লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল রেজাউল জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পাকিস্তানীরা কায়দা করে ২৪শে মার্চ এই রেজিমেণ্টকে চৌগাছা পাঠিয়ে দিয়েছিলো। মেজর ওসমান সংক্ষেপে সর্বশেষ পরিস্থিতিবর্ণনা করে ইপিআর সুবেদার মজিদ মোল্লার মারফত লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে তিনি লেঃ কর্নেল জলিলকে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এই অঞ্চলের সার্বিক কমাণ্ড গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু চিঠির কোন জবাব পাওয়া গেল না। ২৮শে মার্চ মেজর ওসমান দানেশ নামে জনৈক মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে তার কাছে পুনরায় বার্তা পাঠান। শোনা যায় মুক্তিযোদ্ধা দানেশ পুনরায় অনুরোধপত্র নিয়ে লেঃ কর্নেল জলিলের সামনে উপস্থিত হলে তিনি প্রথমে চিঠিটি পড়েন এবং তার পক্ষে বিদ্রোহে যোগ দেওয়া সম্ভব নয় বলে দানেশকে জানিয়ে দেন। এভাবে তাঁর সাথে দেখা না করার জন্যও তিনি দানেশকে সতর্ক করে দেন। এর পরিণতি হয়েছিল করুণ। এই দিন অর্থাৎ ২৮শে মার্চেই লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে ব্যাটালিয়ন নিয়ে তাকে যশোর ফিরে যাওয়ার এবং অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ আসে।

 যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে ১ম ফিল্ড এম্বুলেন্স দলের বাঙ্গালী সৈন্যরা আসন্ন বিপদ অনুভব করতে পেরেছিলো। ২৯শে মার্চ রাতে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সেনারা চৌগাছা থেকে ক্যাণ্টনমেণ্টে ফিরে এলে ফিল্ড এম্বুলেন্সের লোকেরা বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈনিকদের অস্ত্র জমা না দেয়ার আহবান জানায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এর আগেই অস্ত্র জমা দেওয়া শেষ করে সৈনিকরা ব্যারাকে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। ২৯শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তনীরা হঠাৎ প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ঘুমন্ত সৈন্যদের ওপর হামলা করে। বিশ্বাসঘাতকদের এই আক্রমণে অনেক বাঙ্গালী সেনা প্রাণ হারায়। প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিলো এমন কয়েকজন পরে চুয়াডাঙ্গা গিয়ে মেজর ওসমানের সৈন্যদের সাথে যোগ দেয়।

 ১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ওপর হামলার সময় পাকিস্তানীরা শুধু সেনাদেরই হত্যা করেনি, তাদের পরিবার-পরিজন, নারী-শিশুদেরও হত্যা করে। পাকিস্তান দের হত্যা এবং অত্যাচারের হাত থেকে দুগ্ধপোষ্য নবজাতকেরাও রেহাই পায়নি। ফিল্ড এম্বুলেন্সের বাঙ্গালী কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল এস এ হাই এবং তার বাঙ্গালী সহকর্মী ক্যাপ্টেন কালামকে ওরা দুঃসহ নির্যাতনের পর হত্যা করে। এই পরিস্তিতিতে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান এবং তার সহযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আজম ইপিআর সৈন্যদের নিয়ে কুষ্টিয়া মুক্ত করার সিধান্ত নেন। কুষ্টিয়ার ২৭তম বালুচ রেজিমেণ্টের দুইশত সৈন্য থানা, পুলিশ লাইন এবং জেলা স্কুলে অবস্থান গ্রহণ করছিলো। মেজর ওসমান তিনটি ঘাঁটিতেই পর্যায়ক্রমে আঘাত হানার সিধান্ত নেন। ৩০শে মার্চ ভোর ৪টায় প্রথম আঘাত শুরু হয়। সারাদিন যুদ্ধের পর ৫টায় পুলিশ লাইন মুক্ত হয়।

 এখানে অনেক পাকিস্তানী নিহত হয়, কয়েকজন আবার পালিয়ে গিয়ে জেলা স্কুলের প্রধান ঘাঁটিতে যোগ দেয়। ৩১শে মার্চ কুষ্টিয়া শহরের পাকিস্তানী অবস্থান গুলোর ওপর আবার নতুন আক্রমণ শুরু হয়। পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক পুলিশ-ইপিআর-এর সহায়তায় এগিয়ে আসে। তাদের হাতে ছিলো বাঁশের লাঠি, বন্দুক এবং কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল। জনতার ভীড় বেড়ে চলে। দুপুরের মধ্যে বিক্ষুব্ধ জনসাধারণের বিরাট দল পাকিস্তানীদের দ্বিতীয় ঘাঁটি দখল করে নেয়।

 শত্রুরা তখন পিছু হটে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। ২৭-বালুচ রেজিমেণ্টের কোম্পানীর অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে। ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকে কোনভাবে