পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৬৪

 ৩১শে মার্চ থেকে এরা ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত যশোর সেনানিবাসের চতুর্দিক ঘিরে রাখা হয়। সকল গুরুত্বপূর্ণ পথে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয় ও ডিফেন্স তৈয়ার করা হয়। সেই সময় ভারতের সহিত যোগাযোগ করা হয় আধূনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য, কিন্তু প্রথম দিকে সাহায্য পাওয়া যায় নাই। আমাদের হাতে তখন আধুনিক অস্ত্রের সংখ্যা ছিল খুব নগণ্য।

 ৩রা এপ্রিল বিকাল ৩ ঘটিকার সময় পাকবাহিনী যশোর সেনানিবাসের দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। যশোর কলিকাতা রোডের উপর শঙ্করপুর দিয়ে ও যশোর ঢাকা রোড দিয়েও তারা আক্রমণ করে। প্রথমে আর্টিলারি নিক্ষেপ করে ও মর্টার হতে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। গোলা নিক্ষেপ করে পাকসেনারা সম্মুখের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমাদের সম্বল ছিল ২টি ৬ পাউণ্ডার। দুইটিকে দুই রণাঙ্গনে বসান হলো। ৬ পাউণ্ডার থেকে পাকবাহিনীর উপর গোলা নিক্ষেপ করে বেশ কিছুক্ষন তাদের অগ্রগতিকে রোখা গেল। এই দিকে শঙ্করপুরের ৬-পাউণ্ডারটি থেকে কয়েকটি গোলা নিক্ষেপের পর জ্যাম লেগে যাওয়ায় আর গোলা নিক্ষেপ করা যাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকা-যশোর রোডের উপর বসান ৬-পাউণ্ডারটি নিয়ে আসার জন্য অয়ারলেসে বলা হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নিয়ে আসবার সময় পথে পাকবাহিনী ৬ পাউণ্ডার ও চালককে আটকে ফেলে। এই সংবাদ পেয়ে আমাদের পক্ষে বাধা দেওয়ার আর কোন উপায় রইল না। এদিকে পাকবাহিনীর আর্টিলারীর শেলে কয়েকজন জখম হয় ও ছাত্র-যুবকরা হাতিয়ার ফেলে পিছনে চলে আসে। সন্ধ্যার দিকে পাক বাহিনী আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপর গুলি নিক্ষেপ করতে থাকে। এমতাবস্থায় আমরা আস্তে আস্তে পিছনের দিকে চলতে থাকি। ৩রা এপ্রিল সারারাত উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। আমাদের পক্ষে দুই কোম্পানীর মত ইপিআর ও আনসার-মুজাহিদ-ছাত্র যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধে বিশেষ অসুবিধা ছিল। আমি ইপিআর বাহিনীর ক্যাপ্টেন নই, তাছাড়া সকল সৈনিকের ছিল সিভিল পোশাক। তাই সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনায় কিছু 'অসুবিধা হয়। এই যুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী লেঃ মতিউর রহমান এমপিএ বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে ১৫ জন মুক্তিসেনা বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করে শাহাদত্বরণ করেন। এদিকে পাকবাহিনী যশোর দখল করে নেয়। ৪ঠা এপ্রিল আমরা সকালে নড়াইলে পুনরায় একত্রিত হই। সেখানে নতুনভাবে মনোবল নিয়ে নড়াইল-যশোর রোডে দাইতলা নামক স্থানে বিকালে ডিফেন্স নিই। সেই সময় আমাদের জোয়ানদের মোট সংখ্যা ছিল এক কোম্পানী। অপরদিকে সকল আনসার ও মুজাহিদ নিজ নিজ এলাকায় চলে যায়। দাইতলা আমাদের ডিফেন্স খুব শক্ত করে গঠন করি।

 ৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী বিকালের দিকে পুনরায় আক্রমণ করে, কিন্তু আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকসেনা টিকে থাকতে পারলো না। পাকবাহিনীর পিছনে ফিরে চলে যায়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর আনুমানিক ৩০ জনের মত নিহত হয়। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমাদের ডিফেন্স নষ্ট করতে পারেনি। আমাদের পক্ষে কোন হতাহত হয়নি।

 ৮ই এপ্রিল সকালে পাক বাহিনী পুনরায় আমাদের উপর আক্রমণ করে। পাকবাহিনী সেইদিন আর্টিলারী ও মর্টার ব্যাবহার করে। আমরাও তাদের আক্রমণ প্রতিহত করি। প্রায় ৫ ঘণ্টা উভয়পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ হয়। পরে আমাদের গোলাবারুদের অভাবে আর টিকে থাকা গেল না। আমরা পিছনের দিকে চলে আসতে বাধ্য হলাম। নড়াইলে আমার কোম্পানী নিয়ে রাত্রে অবস্থান করি।

 ৯ই এপ্রিল পাক বাহিনী নড়াইল মহকুমা শহরে বিমান হামলা চালায় ও সাথে সাথে দাইতলা থেকে পাক বাহিনী এসে নড়াইল শহর দখল করে নেয়। আমার কোম্পানী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিছু ইপিআর জোয়ান ভারতে চলে যায়।

 আমি পুনরায় গোপালগঞ্জে চলে আসি। সেই সময় গোপালগঞ্জ শত্রুমুক্ত ছিল। গোপালগঞ্জে পুনরায় ছাত্র, যুবক, ইপিার ও সামরিক বাহিনীর জোয়ানদের নিয়ে দুটি কোম্পনী গঠন করি। তাদের রীতিমত প্রশিক্ষণের