পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৬৫

ব্যবস্থা করি। প্রথমে আমার কোম্পানীর হেডকোয়ার্টার গোপালগঞ্জ শহরে গঠন করি। পরে আমার নিজ গ্রাম মানিকহার হাইস্কুলে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। মে মাসের প্রথম দিকে পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের সংবাদ জেনে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে আমাদের নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলতে থাকে।

 ৮ই মে গোপালগঞ্জ থেকে ৫ মাইল দূরে তালা নামক স্থানে ৫টি বার্জ বোঝাই পাট খুলনার দিকে যাচ্ছিল। আমরা তা আক্রমণ করি ও অগ্নিসংযোগ করে বার্জগুলিকে ডুবিয়ে দিই। বার্জগুলিকে বহন করে নিয়ে যাওয়া ‘বিরলা' নামক ছোট জাহাজটিকে আমাদের নদীতে পেট্রোলিং করার কাজে ব্যবহার করি।

 ১১ই মে সকালে ঢাকা থেকে খুলনা অভিমুখে রকেট ষ্টীমার যাওয়ার পথে তালা জাহাজঘাটে জোরপূর্বক আটকিয়ে রাখি। প্রত্যেকটি যাত্রীকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দিই, কারণ অধিকাংশ যাত্রী পাক সরকারের পক্ষে চাকুরীতে যোগদানের জন্য খুলনা যাচ্ছিল। জাহাজটিকে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এবং জাহাজের যাত্রীদের সরকারী চাকুরীতে যেন যোগদান না করে এই শপথ করিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।

 ১১ই মে বিকালে পাকসেনারা স্থানীয় কিছু দালালের সহায়তায় প্রথমে গোপালগঞ্জ প্রবেশ করে। পরে 'আমাদের হেডকোয়ার্টার মানিকহার আক্রমণ করে। প্রথমে আমরা তাদের তীব্র আক্রমণ প্রতিহত করি, কিন্তু পরে তাদের আধুনিক অস্ত্রের মুখে টিকে থাকা গেল না। আমাদের পক্ষে একটি মাত্র এল-এম-পি ছিল। তার চালক নায়েক রব হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ায় আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। পাক বাহিনী মানিকহার গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

 গোপালগঞ্জ পতনের পর ভারত অভিমুখে রওনা হই। পথে বহু বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে ২২শে মে পশ্চিমবঙ্গের বয়রা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি।

যশোর সেনানিবাস ও অন্যান্য স্থানে

১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের তৎপরতা

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দীন আহমদ বীরবিক্রম

২৮-৯-১৯৭৩

 ২৫শে মার্চ ঢাকাসহ প্রদেশের অন্যান্য জায়গায় কি ঘটেছিল তা আমার সম্পূর্ণ অজানা ছিল। সেখানে কোন লোকজনের সঙ্গেও আমার সাক্ষাৎ হয়নি। কেননা ঐ এলাকাটি ছিল জঙ্গলের মধ্যে। এমনকি ২৭শে মার্চ মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী) জিয়াউর রহমান সাহেবের স্বাধীনতা ঘোষণা করার কথাও আমি জানতে পারিনি। আমার সৈন্যরা অনেকে কিছু জানতে পারলেও আমাকে কিছু জানায়নি।

 ২৯শে মার্চ ১২টার সময় অয়ারলেসে-এর মাধ্যমে পাকিস্তানী ১০৭ নং ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দুররানী আমাদেরকে যশোরে পৌঁছতে বলায় আমরা সঙ্গে সঙ্গে জগদীশপুর থেকে যশোরের অভিমুখে রওনা দিই। যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে রাত ১২টায় পৌঁছি। যদিও আমাদের ব্যাটালিয়নে মোট ৭৫০/৮০০ সৈন্য সাধারণত থাকে, কিন্তু অনেক সৈন্য ছুটিতে থাকায় আমাদের ব্যাটালিয়নে সৈন্যসংখ্যা তখন ছিল ৪০০ জন। (ব্যাটালিয়নে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল এবং সে জন্যই প্রায় অর্ধেক ছুটিতে ছিল।)

 ৩০শে মার্চ, ১৯৭১ তারিখে ব্রিগেডিয়ার দুররানী আমাদের ব্যাটালিয়ন অফিসে যান এবং কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জলিলকে বলেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করা হলো এবং আমাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দিতে বলেন। ব্রিগেডিয়ার দুরবানী আমাদের ব্যাটালিয়ন অস্ত্রাগারে অস্ত্রশস্ত্র জমা করে চাবিগুলো নিজ হাতে নিয়ে নেন। মুহূর্তের মধ্যে এ খবর আমাদের ব্যাটালিয়নের সৈন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

[১]


  1. সাক্ষাৎকারদাতা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ৩০ মাইল দূরে কোটচাঁদপুর ও জগদীশপুর এলাকায় কালেকটিভ ট্রেনিংয়ে ছিলেন।