পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৬৯

ভেতরেই দু'পক্ষে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। একদিকে কামান, মর্টার, মেশিনগান প্রভৃতি ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য অপর দিকে হালকা হাতিয়ার সম্বল করে এক ব্যাটালিয়ন বাঙ্গালী সৈন্য। এই যুদ্ধ কতক্ষণ চলতে পারে! স্বাভাবিকভাবেই এই সংঘর্ষে বহু বাঙ্গালী সৈন্য মারা গেল। বাকী সৈন্যরা যুদ্ধ করতে করতে ক্যাণ্টনমেণ্টের বন্ধ দরওয়াজা ভেঙ্গে বাইরে পালিয়ে গেল।

 এই সংবাদ দেখতে দেখতে শুধু যশোর শহর নয়, সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বুঝল, এবার মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে, আর বসে থাকার সময় নেই। ইপি-আর বাহিনী আগে থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে তৈরী হয়েছিল। এবার শহরের পুলিশ বাহিনী যুদ্ধ ঘোষণা করল। এই পুলিশ-বিদ্রোহে যারা নেতৃত্ব নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা হচ্ছেন হিমাংশু ব্যানার্জী, আকমল হোসেন আর পীযুষ। শহরের বিশিষ্ট ফুটবল খেলোয়ার হিসেবে হিমাংশু ব্যানার্জী পুলিশদের মধ্যে নয়, শহরের সাধারণ লোকের মধ্যেও জনপ্রিয়। সেই জনপ্রিয় খেলোয়ারটি এবার এক নতুন খেলায় নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন।

 পুলিশ ম্যাগাজিনের চাবি ছিল অবাঙ্গালী জমাদারের হাতে। হিমাংশু, আকমল আর পীযূষ তাকে বন্দী করে তার হাত থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে ম্যাগাজিন খুলে ফেললেন। সেখান থেকে তারা সাতাশ রাইফেল, ছয়'শ শটগান, কিছুসংখ্যক ব্রেনগান এবং যথেষ্ট পরিমাণে কার্তুজ উদ্ধার করলেন। তারপর এই অস্ত্রগুলিকে বিদ্রোহী পুলিশ আর বিদ্রোহী জনতার মধ্যে বিলি করে দেওয়া হল। স্থির হোল, এদের এখনই অস্ত্রচালনা শিক্ষা দিতে হবে। মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়বার জন্য ব্যাগ্র পুলিশ আর জনতা নিউ টাউনের নোয়াপাড়ার 'আমবাগানে ঘাঁটি করে বসেছিল। এখানে জনতার মধ্যে থেকে তিন'শ জনকে বাছাই করে নিয়ে ষাটজন পুলিশ তাদের রাইফেল চালনা শিক্ষা দিল। মাত্র এক ঘণ্টার মত সময় পেয়েছিল তারা। এইটুকু সময়ের মধ্যেই তারা রাইফেল চালনার অ, আ, ক, খ- টুকু আয়ত্ত করে নিল।

 সেদিন সেই আমবাগানেই এই নবদীক্ষিত শত শত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। জনসাধারণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের আহার্য-দ্রব্য যোগাবার দায়িত্ব নিয়েছিল। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! ঘরের মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এই স্মরণীয় আমবাগানের মধ্যে তাঁদের এই মুক্তিসংগ্রামী ভাইদের জন্য রান্না করছিলেন। এই স্বেচ্ছাসেবিকা নারী বাহিনীকে পরিচালনা করছিলেন হিমাংশু ব্যানার্জীর স্ত্রী।

 সেই দিনই ইপি-আর বাহিনী, ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পালিয়ে আসা বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দুশ'র উপরে সৈন্য, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং ছাত্র-যুবকদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর গড়ে তোলা হোল।

 ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে চারটি সৈন্যবাহী জীপ সম্ভবত শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বেরিয়েছে। মুক্তিবাহিনী তাদের মধ্যে তিনটি জীপকে খতম করে দিল। এখান থেকে মুক্তিবাহিনীর সংগ্রাম শুরু। সেদিন রাত দ’টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ক্যাণ্টনমেণ্টের শালতলা এলাকায় পাক-সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে প্রচুর গুলি বিনিময় হয়।

 সেই রাত্রিতেই যশোর জেলের কয়েদীরা বাইরের খবর শুনে চঞ্চল হয়ে উঠে। তারা জোর করে জেল থেকে বেরিয়ে আসতে চায় এবং তাই নিয়ে জেল প্রহরীদের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় এবং গুলি চলে। শেষ পর্যন্ত তার পরদিন রাত্রিতে সেখানকার ১৩৭৫ জন বন্দী জেলের দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। তাদের মধ্যে সতেরো জন ছিলেন নিরাপত্তা বন্দী। এটা ৩০ তারিখ রাতের ঘটনা।

 ৩০শে মার্চ ভোরবেলা দু'দল পাক-সৈন্য ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বেরিয়ে এসে জীপে করে দু'দিকে যাত্রা করল। একদল এখানকার চাঁচড়ার দিকে, আর একদল খুলনার দিকে। মুক্তিবাহিনীও দু'দলে ভাগ হয়ে তাদের প্রতিরোধ করবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাক-সৈন্যদের মধ্যে যে দলটি খুলনার দিকে যাত্রা করেছিল, পুরাতন কসবার পুলের কাছে তাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ ঘটল। এই সংঘর্ষে পুলিশদের নেতা হিমাংশু ব্যানার্জী নিহত হলেন। চাঁচড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে আচ্ছামত ঘা খেয়ে পাক-সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরে ঢুকে পড়ল। মুক্তিবাহিনী ক্যাণ্টনমেণ্ট অবরোধ করে রইল।