যশোর শহর মুক্তিবাহিনীর হাতে। এই তিনটি দিন শহরের মানুষ এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছে। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। গ্রামাঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ, কখনও দলে দলে, কখনও বা বিচ্ছিন্নভাবে যে যার হাতিয়ার উঁচিয়ে নিয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে। আওয়ামী লীগ আর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রতিরোধের বাণী ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। তাদের সেই সংগ্রামী অহবান ব্যর্থ হয়নি। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে দলে দলে ছুটে আসছে মানুষ। তারা এই বর্বর হামলাকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তাদের এই সোনার দেশকে মুক্ত করবে, স্বাধীন করবে।
ঘরের মেয়েরাও এগিয়ে আসতে চাইছে। এই মুক্তিসংগ্রামকে সফল করে তুলবার জন্য তারাও কিছু করতে চায়। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘরে ঘরে রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। কেউ তাদের বলুক আর নাই বলুক, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘরে খাবার তৈরী করে চলেছে। যে যা পারছে সে তাই দিয়ে চলেছে। নিজেরা এগিয়ে গিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই সুযোগ থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না।
পর পর তিন দিন ধরে অবরোধ চলছে। হাজার হাজার লোক ঘিরে আছে ক্যাণ্টনমেণ্টকে। দিন-রাত্রি অষ্টপ্রহর ধরে তারা পাহাড়া দিয়ে চলেছে। ক্যাণ্টনমেণ্টের পেছন দিকে বিল অঞ্চল। সেখানেও পাহাড়া চলেছে, যাতে এরা কোন দিক দিয়ে বেরোবার পথ না পায়। রাইফেল বা বন্দুক ক'জনের হাতেই বা আছে। গ্রামের মানুষ হাতিয়ার বলতে যার যা সম্বল তাহা নিয়ে ছুটে এসেছে। বর্শা, বল্লম, রামদা, লেজা থেকে লাঠিসোঁটা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, পথের মোড়ে মোড়ে গাছের উপর অনেকে তীর-ধনুক নিয়ে বসে আছে। দুশমনরা একবার ওদের কোট ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেই হয়। একটাকেও জ্যান্ত ফিরে যেতে হবে না।
যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট এক বিরাট ঘাঁটি। এখানে প্রায় সতের হাজার সৈন্য থাকার ব্যাবস্থা আছে। তাছাড়া এরা ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। কয়েকশ রাইফেল, কয়েকটা লাইট মেশিনগান আর কেবলমাত্র একটা পাঁচ পাউণ্ড গোলা কামান দিয়ে এদের প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। যুদ্ধের ব্যাপারে সাহস অত্যন্ত প্রয়োজন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ যুগে শুধু সাহস দিয়েই যুদ্ধ জয় করা চলে না। এই প্রতিরোধ সংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা হয়তো এ বিষয়ে পুরোপুরি সজাগ ছিলেন না।
তাছাড়া মুক্তিবাহিনীর আরেকটা দুর্বলতা ছিল তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। বীর জনতা তিন দিন ধরে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে হাজার হাজার পাক-সৈন্যকে অবরোধ করে রাখল, অথচ সেই খবরটা সময় মত তাদের সদর দফতর চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে পৌঁছল না। আর যদি পৌঁছেও থাকে, তবে মূল নেতৃত্ব সাড়া দেয়নি। সে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কট-মুহূর্তে তাদের শক্তি সম্পদ যশোরে এনে সমাবেশ করার প্রয়োজন ছিল। তাহলে যুদ্ধপরিচালনার ব্যাপারে অভিজ্ঞ যোদ্ধারা থাকতেন এবং আরও কিছু ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহার করা যেত। অবশ্য তাহলেই যে তারা যুদ্ধ জয় করতে পারতেন, এমন কথা বলছি না। তবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, তার ফলে সেইদিন যশোর শহর একটা প্রচণ্ড যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারত এবং তারা বহু শত্রুসৈন্যকে খতম করতে পারত।
অবরোধের তৃতীয় দিনে অবরোধকারীদের সংখ্যা কমতে কমতে অবরোধের বেষ্টনীটা একটু পাতলা হয়ে এসেছিল। উপযুক্ত সময় বুঝে অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যরা কামানের গোলায় পথ করতে করতে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর দু'পক্ষে চলল যুদ্ধ। কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে রাইফেলের লড়াই, এ এক দুঃসাহসিক অথচ মর্মান্তিক দৃশ্য। এই যুদ্ধে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা অদ্ভুত বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু এসবই অগ্নিস্রাবী কামান আর ভারী মেশিন গানের সামনে এই প্রতিরোধ কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে! যশোরের রাজপথ রক্তে লাল হয়ে গেল, কত দেশপ্রেমিক এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন তার হিসেব কেউ দিতে পারবে না। যুদ্ধ সমস্ত শহরময় ছড়িয়ে পড়েছিল, শহরের পথগুলি অসংখ্য দেশভক্তের মৃতদেহে বিকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধত্মদের মধ্যে যারা বেঁচেছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধকে পুনর্গঠন করবার সঙ্কল্প নিয়ে শহর ছেড়ে বাইরে চলে গেল। এইভাবে যশোরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল।