পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৭৪

মেশিনগানের অবিরল গুলিবর্ষনের ফলে ওদের মধ্যে প্রচুর লোক মারা গেল। বাকী সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণ নিয়ে পালাল।

 ওরা পালিয়ে গেল বটে, কিন্ত আমাদের নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম নেবার সময় দিল না। একটু বাদেই ওদের একটা বড় দল আমাদের উপর এসে হামলা করল। ওরা অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়েই এসেছিল, সঙ্গে মেশিনগান ও ছিল, কিন্তু ওরা এবার বরাবর সোজা পথ ধরে আসেনি। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে হঠাৎ এক সময় উঠে দেখলাম, ওরা দুটো দলে ভাগ হয়ে দু'দিক থেকে সাঁড়াশীর মত আক্রমণ করেছে এবং আমরা প্রায় ঘেরাও হয়ে যেতে বসেছি।

 আমাদের উপর দুদিক থেকে গুলিবর্ষণ চলেছে আমরা যেন গুলির বেড়া জালের মধ্যে আটকে পড়তে যাচিছ। আমাদের সঙ্গে সাহায্য করার মত যারা ছিল তারা সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গিয়েছে। আমাদের মধ্যে একে একে পাঁচজন যোদ্ধা শহীদ হলেন। কিন্ত তবু আমরা আমাদের মনোবল হারাইনি। আমাদের তিনটি মেশিন গান অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গুলি করতে করতে পিছিয়ে যাচিছল। শেষ পর্যন্ত আমরা যথেষ্ট কৌশলের পরিচয় দিয়ে সেই মৃত্যু-ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এলাম।

 শত্রুপক্ষ বুঝল, লড়াইয়ের পথ এখনও তাদের জন্য কণ্টকমুক্ত নয়। তাই তারা আর বেশী দূরে না গিয়ে যশোর শহরে ফিরে এল। ইতিমধ্যে নড়াইল এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, পাক সৈনদের এক বিরাট বাহিনী নড়াইল আক্রমণ করতে রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। নড়াইল শহরের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে লাগল। আবার সেই রাত্রিতেই ওরা নড়াইল শহরের উপর মারাত্মক রকম বোমাবর্ষণ করল। বিস্ফোরণের আগুনে জ্বলতে লাগল নড়াইল শহর। অবস্থা গুরুতর মনে করে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নড়াইল শহর ছেড়ে লোহাগড়ার দিকে চলে গেল।

 পরদিন যশোর থেকে এক বিরাট মিলিটারি বাহিনি নড়াইল এসে হামলা করল। তাদের সঙ্গে ছিল তাদের বিহারী ও বাঙ্গালী দালালরা। ওরা লুটের লোভে উন্মত্ত হয়ে ছুটে এসেছে। ওদের বাধা দেওয়ার মত কেউ ছিল না। ওরা নিশ্চিন্ত মনে নড়াইল শহরের ঘরে ঘরে মনের সাধ মিটিয়ে লুটপাট করে শেষ ফিরে গেল যশোর শহরে। তখন নড়াইল শহরে বেসামরিক বা সামরিক কোন শাসনই রইল না। কুখ্যাত গুণ্ডা টগর সেই সুযোগে সারা শহরের উপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে যা খুশি তাই করে চলল।

 মূল মুক্তিবাহিনী চলে গেছে লোহাগড়া। আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তারাও ছত্রভঙ্গ হয়ে কে কোথায় চলে গেছে। এবার আমরা তিনজন মুক্তিবাহিনী থেকে বিচিছন্ন হয়ে পড়লাম। আমরা স্থির করলাম আমদের নিজেদের এবার নিজেদের পথ বেছে নিতে হবে, নিজেদের উদ্যোগেই মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শত্রুপক্ষ যতই প্রবল হোক না কেন এবং আমাদের অবস্তা যতই প্রতিকূল হোক না কেন আমরা কিছুতেই এই সংগ্রাম ছেড়ে পেছনে হটে যাব না। আমরা তিনজন আর আমাদের মেশিনগানটি, এই আমাদের শক্তি, এই আমাদের সম্বল। এই নিয়ে আমরা আমাদের নতুন পথে যাত্রা করলাম।

 আমাদের প্রথম কাজ হোল নড়াইল গিয়ে টগর গুপ্তাকে উচিত মত শিক্ষা দেওয়া। আমরা সোজাগিয়ে তার সঙ্গে মোকাবিলা করলাম। টগর তার দলবল নিয়ে অবাধে লুটপাট চালিয়ে যাচিছল। তাদের সঙ্গে বাক্য বিনিময়ের ইচ্ছা বা সুযোগ আমাদের ছিল না, দেখা হওয়া মাত্রই আমাদের গুলিবিনিময় চলল। কিন্তু আমাদের মেশিনগানের সামনে ওরা কি করে দাঁড়াবে! টগর প্রাণের ভয়ে আত্মসমর্পণ করল। আমরা দেশের শত্রু সেই শয়তান মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করলাম। তরপর পরপর তারই মত আরও কয়েকজন দেশদ্রোহীকে হত্যা করা হলো।