পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৭৫

 এবার আমরা নড়াইল শহর ছেড়ে লোহাগড়ার কাছে দীঘলিয়া গ্রামে চলে গেলাম। আমরা স্থির করেছিলাম, এবার আমরা নিজেদের উদ্যোগে একটি নতুন মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলব। এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছাত্র ও যুবকদের অভাব ছিল ন। সামরিক ট্রেনিং পাওয়ার জন্য তারা অধীর হয়ে উঠেছিল। আমার ডাকে দেখতে দেখতে অনেক ছাত্র ও যুবক এসে জুটল। আমি দীঘলিয়াতে ট্রেনিং সেণ্টার স্থাপন করে এই সমস্ত শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং দিয়ে চললাম। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা শেষ পর্যন্ত চল্লিশ-পঞ্চাশ জনে দাঁড়াল।

 এদিকে পাক সৈন্যদের জয়লাভের ফলে স্থানীয় দালালরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল চোর, ডাকাত, লুটেরা আর গুণ্ডা বদমাসের দল। ওরা এই সুযোগে নিজেদের ফায়দা উসুল করে নিচ্ছিল। ওদের পেছনে সামরিক সরকার সমর্থন রয়েছে, তাই তারা নিশ্চিন্ত ছিল যে, তারা যা-ই করুক না কেন, কেউ তাদের বাধা দিতে সাহস করবে না। দীঘলিয়ার কুখ্যাত চেয়ারম্যান নওশের আলী ছিল এমনি একজন নামকরা দালাল। আমাদের মুক্তিবাহিনীর খবর শুনে তার টনক নড়ল। সে টাকা পয়সা ছড়িয়ে চারদিক থেকে হাজার দুই গুণ্ডা জাতীয় লোক এনে জড় করে আমাকে ধরতে এল। আমাকে ধরাটা সহজ নয়, এটা সে, আগেই বুঝতে পেরেছিল। তার জন্যই তার এত তোড়জোড়া। আমি খবরটা পেয়েই দীঘলিয়া বাজার ‘কারফিউ জারী করে দিয়েছিলাম। আমাদের মুক্তিবাহিনীর ছোট একটা গ্রুপ নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করলাম। কিন্তু যুদ্ধ করার প্রয়োজন হলো না, আমাদের মেশিনগানের আওয়াজ শুনে দালাল নওশের আলীর ভাড়াটে গুণ্ডাগুলি দেখতে দেখতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল।

 কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, জায়গাটা আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়। আমাদের অন্যত্র সরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্ত যাবার আগে দালাল নওশের আলীর লীলাখেলা শেষ করে দিয়ে যাব। এই সঙ্কল্প নিয়ে আমি তখনকার মত আমাদের এই মুক্তিবাহিনীকে ভেঙ্গে দিলাম। তারপর সে অঞ্চলে পনের-ষোল দিন আত্মগোপন করে ছিলাম। একদিন উপযুক্ত সুযোগে শয়তান নওশের আলীকে হত্যা করা হয়। তারপর আমি আর আমার দুই সাথী সেই অঞ্চল ছেড়ে এলাম ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে।

 আমরা গোপালগঞ্জ মহকুমার চন্দ্রদীঘলিয়া গ্রামে এসে আশ্রয় নিলাম। দেখতে দেখতে এখানেও এক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠল। আমাদের দৃষ্টি রইল গোপালগঞ্জ শহরের দিকে। সেখানে তখন মুসলিম-লীগ পন্থী, জামাত পন্থী প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল দেশদ্রোহীদের অপ্রতিহত রাজত্ব চলছে। পুরানো এসডিওকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় একজন অবাঙ্গালীকে নিয়োগ করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ শহর তখন শত্রুপক্ষের দূর্ভেদ্য দুর্গস্বরূপ। পরিকল্পনা নিলাম, ওদের সেই দুর্গের ভেতর ঢুকে পড়ে ওদের উপর হামলা চালাব। এই পরিকল্পনা যদি সফল হয়, তবে সমস্ত মহকুমা জুড়ে মুক্তিবাহিনীর প্রভাব ও মর্যাদা বহু গুনে বেড়ে যাবে।

 কিন্ত আমরা তিনজনই শুধুই সেখানে যাব, যা করবার আমরা তিনজনেই করব, মুক্তিবাহিনীর আর কউকে সঙ্গে নেব না। এ কাজ করতে হবে অত্যন্ত কৌশলে। ওরা যদি আগে থেকে টের পেয়ে যায়, তাহলে একজনকেও সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে হবে না। আমার প্যরাট্রুপারের ট্রেনিং এর অভিজ্ঞতাটাকে এবার ভাল করে কাজে লাগাতে হবে। খুবই দুঃসাহসের কাজ। আমরা তিনজন সেই বিপজ্জনক পথে পা বাড়ালাম।

 গভীর রাত্রিতে অতি সন্তর্পণে আমরা তিনজন গোপালগঞ্জ শহরে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। শান্ত শহর ঘুমিয়ে আছে, কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। আমাদের ভাগ্য ভাল, আমরা কোথাও কোন পাহারাদারের নজরে পড়ে যাইনি। কি করে অত্যন্ত দ্রুত ও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শত্রুপক্ষের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হয়, সেই শিক্ষা আমার ভাল করে জানা ছিল। এবার তা কাজে লেগেগেল। আমরা যন্ত্রের মত কাজ করে চলেছিলাম। দেখতে দেখতে ওদের বেতার প্রেরণ ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিলাম। কেটে ফেললাম টেলিগ্রাম আর টেলিফোনের তার। গোপালগঞ্জ শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কিন্তু এমন সতর্কতার সঙ্গে এই