পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৭৬

কাজগুলি করেছিলাম যে, একটি জন-প্রাণীও তা টের পায়নি। এইভাবে আমাদের প্রাথমিক কাজ সমাপ্ত করে নিয়ে আমরা তিনটি নিশাচর প্রাণী দিবালোকের প্রতিক্ষায় রইলাম।

 অবশেষে রাত্রির অন্ধকার কেটে দিনের আলো দেখা দিল। ক্রমে বেড়ে উঠল বেলা। আমরা আমাদের গোপন আশ্রয় ছেড়ে প্রকাশ্যভাবে বেরিয়ে এলাম পথে। পথের মানুষ আমাদের দেখে চমকে উঠল। ভয় পেয়ে দু'ধারে সরে গিয়ে আমাদের পথ করে দিল। আমরা আমাদের মিলিটারি বুটের খট খট শব্দে রাজপথ ধ্বনিত করে সোজা পুলিশ ব্যারাকে গিয়ে উঠলাম। ব্যারাকে ঢুকেই চমকে উঠলাম আমি। আমরা সংবাদ পেয়েছিলাম, ব্যারাকে মাত্র জনকয়েক পুলিশ আছে। কিন্তু আমরা এক অগ্নিপরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে, আমাদের ভয় করলে চলবে না। এখন যা হবার তা হোক।

 আমাদের দেখে ওরা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল। ওরা আমাকে পাঞ্জাবী অফিসার বলে মনে করেছিল। এমন ভুল অনেকেই করে থাকে। এরই উপর ভরসা করে আমি এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা নিয়ে গোপালগঞ্জ শহরে এসেছি। বলতে গেলে জেনেশুনেই বাঘের মুখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি মিলিটারি অফিসারের গাম্ভীর্য নিয়ে পরিষ্কার উর্দু ভাষায় বললাম, আমি সামরিক হেডকোয়াটার থেকে এসেছি। তোমাদের উপর নির্দেশ, তোমরা এখনই তোমদের অস্ত্র আমার সামনে এনে জমা করবে।

 ওরা আমার নির্দেশ শুনে অবাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। তারা এই অর্ডারেরমানে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। তারা তো বাঙ্গালী পুলিশ নয়, তবে তাদের এভাবে নিরস্ত্র করা হচ্ছে কেন? আমি তাদের আর বেশী ভাববার সময় না দিয়ে বজ্রগর্জনে সেই নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করলাম। এবার ওরা ঘাবড়ে গিয়ে একে একে সবাই সুড়সুড় করে আমার নির্দেশ পালন করল। পাশেই ছোট একটা ঘর। সেখানে রাইফেলগুলি স্তূপীকৃত হয়ে উঠল। এবার আমরা ওদের একটা হলঘরেরমধ্যে ঢুকিয়ে দরজায় তালা বন্ধ করে গট গট করে চলে এলাম বাইরে। এইখানে প্রথম দৃশ্যের শেষ।

 এবার দ্বিতীয় দৃশ্য। আমরা যে পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম, তার মধ্যে ট্রেজারি আর ব্যাঙ্ক লুট করার কথাও ছিল। কিন্ত এখন বুঝলাম অবস্থা গুরুতর। আপাতত আমাদের পরিকল্পনা থেকে সে দুটো ছাঁটাই করেই দিতে হবে। এবার পুলিশ ব্যারাক পেছনে ফেলে নবনিযুক্ত এসডিওর কুঠিতে গিয়ে উঠলাম। খবর পাঠাবার একটু বাদেই সেই অবাঙ্গালী এসডিও হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের সামনে চলে এল। আমার দিকে চোখ পড়তেই সে সসম্মানে আমাকে স্যালুট দিল। আমি তাকে উর্দু ভাষায় বললাম আমি সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জরুরী নির্দেশ নিয়ে এসেছি। এক্ষুণি মুসলিম লীগের আফসার উদ্দিন মোল্লা ও সিদ্দিক সিকদারকে ডেকে পাঠান। একটা বিষয় নিয়ে ওদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। এসডিও অতি সমাদরে আমাদেরকে একটা ঘরে নিয়ে বসালেন। একটু বাদেই যাদের ডাকানো হয়েছিল তারা এসে উপস্থিত হলো। ওরা ঘরে এসে ঢুকবার সাথে সাথেই আমরা তিনজন উঠে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ধরলাম। একই সঙ্গে তিনটি রাইফেল গর্জে উঠল। ওদের কথা বলবার সময়টুকু পর্যন্ত ছিল না। তিনটি দেহ একই সঙ্গে ভূমিশয্যায় লুটিয়ে পড়ল। এমনি করে পর পর তিন বার গুলি ছুড়লাম, তারপর কাজ শেষ করে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

 পেছনে লোকজনের কোলাহল আর হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকাবার সময় নেই আমাদের। আমরা যেন ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছি। এতক্ষণে মনে পড়েছে, একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে; সেটিকে শেষ করে যেতে হবে। আমরা ছুটতে ছুটতে গিয়ে মুসলিম লীগের নেতা ওয়াহিদুজ্জামানের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সামরিক সরকারের বড় দালাল ওয়াহিদুজ্জামান। কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হতে হলো। খবর নিয়ে জানলাম ওয়াহিদুজ্জামান বর্তমানে গোপালগঞ্জে নেই। না-ই বা থাকল ওয়াহিদুজ্জামান, তার ভাই ফায়েকুজ্জামান তো আছে। সেও তো এই অপকর্মে তার ভাইয়ের সাথী। আপাতত তাকে দিয়ে আমাদের কাজ