পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



২৮৫

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

দু’মাইল নিকট চেকপোষ্ট তৈরী করা হয়। সেখানে বংগশার্দুলদের (৩৩ জন ছিল) সবাইকে একটা অন্ধকার দালানে তালা বন্ধ করে রাখা হয়। লেঃ সিরাজুল ইসলাম এবং রফিককে অন্য কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।

 আমাদের কাছে কোন আয়ারলেস সেট না থাকাতে বাইরের কোন খবর পাচ্ছিলাম না। ঢাকা থেকেও কোন খবর পাই নাই। কিন্তু সৈয়দপুরে আমরা মোট ১২০ জন ছিলাম। আমরা সব সময় সতর্ক ছিলাম। আমাদের অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে ছিল।

 ২০শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত আমরা কোন চিঠিপত্র পাচ্ছিলাম না। ৩১শে মার্চ প্রচুর চিঠিপত্র আসল। আমি ওগুলো দেখতে পারলাম না, কেননা মেজর আখতার, ক্যাপ্টেন মালিক এবং আরো অনেকে আমার কোয়ার্টারে এসেছিল।

 তারা বেলা ১টার সময় আমার বাসা থেকে চলে যায়। তারপর আমি অফিসে গেলাম। মেইল দেখে বাসায় ফিরছিলাম। মেজর আখতারকে আমাদের কমাণ্ডিং অফিসারের গাড়ীতে করে ঘুরতে দেখলাম।

 আমি বাড়ীতে পৌঁছলাম এবং খেতে বসলাম। তখনও আমি জীপের আওয়াজ শুনছিলাম। আগে থেকেই মেজর আখতারের কার্যকালাপ সন্দেহজনক ছিল। তাই খাওয়া ছেড়ে আমি বেরিয়ে আসলাম। সুবেদার আলী আহম্মদকে জীপটা সম্বদ্ধে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল যে, মেজর আখতার সুবেদার মেজর হারিস মিয়াকে ২৬এফএফ-এর কমাণ্ডিং অফিসারের কাছে নিয়ে গিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি সেখানে গেলাম এবং সুবেদার-মেজর এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনকে সেখানে দেখলাম। আমাদের কমাণ্ডিং অফিসার ২২৬এফ, এফ রেজিমেণ্ট অফিস থেকে ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও সুবেদার-মেজর হারিস মিয়াকে উপস্থিতির জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। সে সংবাদ আমাকেও তারা জানান। ওখানে বসা অবস্থায় আবারও কমাণ্ডিং অফিসারের টেলিফোন আসে না। তিনি ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে ২৬এফ-এফ-এর অফিসে সুবেদার-মেজরসহ যাওয়ার জন্য পীড়াপীড় করছিলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাতে সায় দেন নাই। বরং তিনি সি-ওকে নিজেদের অফিসে আসার জন্য অনুরোধ করছিলেন। কমাণ্ডিং অফিসারের নির্দেশ অমান্য করার প্রধান কারণ হল মেজর আখতারের সন্দেহজনক কার্যকালাপ-যেহেতু তিনি নিজ অফিস সত্ত্বেও এক মুহুর্তের জন্যও তাঁর জীপ অফিসের সামনে দাঁড় করান নাই। কমাণ্ডিং অফিসার আবার ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে বলেন “আনোয়ার, অনুগ্রহ করে তুমি তাড়াতাড়ি চলে আস-ম্যায় তোমহারা ভালাই কালিয়ে বোলা রাহা হোঁ।” আমি ক্যাপ্টেন আনোয়ারের টেলিফোন হ্যাণ্ড সেটের সংলগ্ন থাকায় কমাণ্ডিং অফিসারের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। সে কণ্ঠস্বর কাঁপছিল বলে মনে হচ্ছিল। সুতরাং আমি তাদের যাবার জন্য সায় দিলাম না। তৎক্ষণাৎ সেখানে নায়েক সুবেদার (এ্যাডজুট্যাণ্ট) শহীদউল্লা ভূইঞা (শহীদ) উপস্থিত হন। আমরা সবাইকে সতর্ক থাকতে উপদেশ দিয়েছিলাম। আনুমানিক ১৫/২০মিনিটের মধ্যে সমস্ত পরিবারবর্গ আমার বাসায় সমবেত হয়।

 ঠিক ১লা এপ্রিল রাত ২-৪৫ মিনিটের সময় গোলন্দাজ বাহিনীর শেল বা গোলা আমাদের মোটর ট্রান্সপোট গ্যারেজ ও পেট্রল ডাম্পে এসে পড়ে। সেখানে সমস্ত যানবাহন আগুন লেগে ভস্মীভূত হয়। এত ভীষণভাবে গোলা বর্ষণ হচ্ছিল যার দরুন রাস্তার উপর বৈদ্যুতিক তারসমূহ ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কয়েকটা দালান, অস্ত্রাগার, খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ গুদাম ধসে পড়ে যায়। তবুও অসমসাহসী ১২০ জন বংগশার্দুল সকাল ৮-৩০-মিনিট পর্যন্ত বীর বিক্রমে তাদের ওপর এই কাপুরুষোচিত আক্রমণকে প্রতিহত করে। জনশক্তি কম থাকায় এবং অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ না থাকায় তারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। শত্রর সংখ্যা ১৬০০ ছিল এবং তারা আধুনিক ভারী এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল।