পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



২৮৬

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

 ১লা এপ্রিল ভোর ৫-৩০ টা নাগাদ আমি সমস্ত পরিবার-পরিজনকে (তারা প্রায় ৩০০ ছিল) নিকটবর্তী গ্রামের দিকে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হই।

 এরপর আমি আমার বাসার নিকটবর্তী পরিখায় ১টা ষ্টেনগান, একটা এলএমজি এবং কিছু গোলাবারুদসহ অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সকাল ৮-৩০টার সময় আমার সামনে একটা মটারের গোলা এসে পড়ে। সুতরাং আমি পরিখা ত্যাগ করে গ্রামের দিকে অন্যান্য সঙ্গীদের খোঁজে চলে যাই।

 আনুমানিক ১২-৩০টার সময় সেনানিবাস থেকে প্রায় ৫/৬ মাইল দূরে ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি তখন আমার যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়ম অনুসারে আমার সুবেদার পদবী কাঁধ থেকে অপসারিত করেন এবং সান্ত্বনা দেন। আমরা আমাদের সৈন্যসংখ্যা গণনা করে মাত্র ৫০ জন দেখতে পেলাম। তারপর আমরা অন্যান্যদের খোঁজে বেরুলাম। কিছুসংখ্যক গুলীবিদ্ধ সৈন্যকে নিকটবর্তী বদরগঞ্জ বেসামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। পাঁচজন বংগশার্দুল শহীদ হয়। বাকি সবাইকে দূরদূরান্ত থেকে একত্রিত করা হয়।


 পূর্বে রাত্রে প্রায় ৪-৪৫টার সময় আমি সুবেদার রহমতউল্লার কাছে একটি চিরকুট পার্বতীপুর পাঠাই। সেখানে মেজর শাফায়াত হোসেনের (পশ্চিম পাকিস্তানী) অধীনে প্রায় ৫০ জন বংগশার্দুল ছিলেন। উক্ত চিরকুট তার কাছে বেলা ৮ ঘটিকায় পৌঁছে এবং তার মর্মানুসারে তিনি মেজর শাফায়াতকে হত্যা করে আমাদের সাহায্যের জন্য গ্রামের পথে অগ্রসর হন। সৌভাগ্যবশতঃ তার সাথে পথিমধ্যে আমাদের দেখা হয়। অনুরুপ সংবাদ ঘোড়াঘাটে মেজর নিজামউদ্দিন আহম্মদের কাছেও পাঠানো হয়। কিন্তু মেজর নিজামুদ্দীন উক্ত সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও কমাণ্ডিং অফিসারের বিনা অনুমতিতে সেখান থেকে আসতে অস্বীকার করেন।


 ঘোড়াঘাটের সংঘর্ষে যে তিনজন বংগশার্দুল শাহাদৎবরণ করেন তাদের দাফনের জন্য সুবেদার আওয়াল খান (পাঠান)-কে দায়িত্ব দেয়া হয়। তার সাথে ১২ জন প্রহরী দেয়া হয়েছিল। সে তখন মৃতদেহ নিয়ে কারমাইকেল কলেজের (রংপুর) সামনে আসে ও রাস্তা অতিক্রম করতে থাকে তখন পথিমধ্যে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সে গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে পাক সেনারা গুলী ছুড়তে শুরু করে। গুলীতে ১১ জন বংগশার্দুল নিহত হয়। আওয়াল খান গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। তাকে ছাত্ররা ধরে পিটিয়ে হত্যা করে।

 খান সৈন্যদের হত্যাযজ্ঞঃ যাদেরকে (৩৩ জন) সৈয়দপুরের দু’মাইল দূরবর্তী অন্ধকার দালানে তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছিল তাদের সবাইকে রাত দুটা ৪৫ মিনিটে গুলী করে হত্যা করা হয়। সেখানে আব্দুল কাদের নামক একজন সিপাহী মৃতদেহের স্তুপের মধ্য থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। আমাদের ব্যাটালিয়নের প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ সৈন্য বদরগঞ্জের নিকটবর্তী খোলাহাটী নামক জায়গায় একত্রিত হয়।

 আমরা ২/৩ রা এপ্রিল পার্বতীপুর আক্রমণ করি এবং পাক বাহিনীকে প্রতিহত করা হয়। কিন্তু পার্বতীপুর শহর দখল করতে ব্যর্থ হই।

 ১২ এপ্রিল বদরগঞ্জে পাক বাহিনীর সাথে (১৫ টি ট্রাক বোঝাই) আমাদের সংঘর্ষ হয়। পাক বাহিনীকে পর্যদস্ত করা হয়। আমি এবং সুবেদার শহীদুল্লাহ এই যুদ্ধের কমাণ্ড করেছিলাম।

 ১৩ই এপ্রিল পাক বাহিনী ট্যাংক নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হই। বদরগঞ্জ সংঘর্ষ শুরু হওয়ার প্রায় দু’ঘণ্টা আগে রংপুর থেকে রংপুরের তৎকালীন এস-পি বদরগঞ্জ থানা পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে ২৯ ক্যাভলরির একজন মেজরকে পাঠান ড্রাইভারের বেশে বদরগঞ্জে নিয়ে আসে। এস-পির সাথে কথোপকথনের পর উক্ত ড্রাইভারের পরিচয় জানতে চাওয়ায় তাকে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের ড্রাইভারের পরিচয় দেয়া হয়। কিন্তু উক্ত মেজর (ড্রাইভার) আমার আগের পরিচিত ছিল। আমি তাকে চ্যালেঞ্জ করায় সে স্বীকার করে। পরে তাকে আমাদের ক্যাম্পে পাঠানো হয় ও হত্যা করা হয়। এস-পিকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।