পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



২৮৯

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

প্রশিক্ষণ দানের কাজ শুরু করি। এম-সি-এ করিম উদ্দিন সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ঐ দিনই রংপুর জেলার ভারত সীমান্তবর্তী পাটগ্রাম, লালমনিরহাট, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, থানার সমস্ত ইপিআর ফাঁড়িগুলোতে সংবাদ পাঠানো হয়। এই সংবাদে সাবেক ইপিআরদেরকে সশস্ত্র অভিযানের জন্য সংগঠিত হয়ে একযোগে রংপুর শহরে অবস্থিত সামরিক গ্যারিসনের দিকে অগ্রসর হবার জন্য আবেদন জানানো হয়েছিল।

 ১লা এপ্রিল সাবেক ইপিআর কোম্পানী প্রধান সুবেদার বোরহান উদ্দীন বাঙ্গালী ইপিআরদেরকে সংঘবদ্ধ করে পাকিস্তানী সৈন্যদের অগ্রাভিযান প্রতিরোধের জন্য কাকিনা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ডিফেন্স দেন। এদিকে আমি দ্রুত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানী গড়ে তুলি। এই কোম্পানী দুটির কমাণ্ডার ছিলেন যথাক্রমে মুজাহিদ তমিজ উদ্দিন এবং আনসার কমাণ্ডার রিয়াজ উদ্দিন। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন পরে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে নিহত হন। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন তার কোম্পানীসহ সুবেদার বোরহানের কোম্পানীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কমাণ্ডার রিয়াজউদ্দিনকে তার কোম্পানীসহ গঙ্গাচড়া ও কালীগঞ্জ থানার তিস্তা নদীর তিনটি ঘাট পাহারায় নিয়োজিত করা হয়েছিল।

 ৮ই এপ্রিল রাত ১টার দিকে সুবেদার বোরহানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কোম্পানী লালমনিরহাট থানা হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের পরপরই সুবেদার বোরহান তার কোম্পানীকে সরিয়ে কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরের দিকে নিয়ে যান।

 ৯ই এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা কালী বাজারের কাছাকাছি এসে পড়লে আমরা সবাই সরে পড়ি। ১৪ই এপ্রিল ফুলবাড়ী থানায় উপস্থিত হই। এই ফুলবাড়ী থানাতেই সাবেক ইপিআর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেবের সাথে আমাদের দেখা হয়। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের সাথে ঐসময় দ্বিতীয় কোন অফিসার ছিল না তিনি আমাকে ভারত সীমান্তবর্তী থানা ভুরুঙ্গামারীতে নিয়ে যান। আমি নওয়াজেশ সাহেবের সহকারী হিসাবে কার্যভার গ্রহন করি। প্রকৃতপক্ষে ভুরুঙ্গামারী থানা হেডকোয়ার্টার ঐ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পুরো সেক্টরে পরিণত হয়েছিল। রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে থেকে সাবেক ইপিআর মুজাহিদ-আনসার এবং স্কুল-কলেজের ছাত্রবৃন্দ দলে দলে ভুরুঙ্গামারী থানায় আসতে থাকে। আমরা তাদেরকে নিয়ে ছয়টি কোম্পানী গঠন করি। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ভুরুঙ্গামারী থানা সদরেই দেয়া শুরু হয়। সুবেদার বোরহান পাঁচগাছি থেকে কাউয়াহাগা পর্যন্ত ধরলা নদীর বিস্তৃত নদী তীর এলাকা জুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি কোম্পানী মোতায়েন করেন। অপরদিকে সাবেক ইপিআর সুবেদার আরব আলী কাউয়াহাগা থেকে গোরল মঞ্জিল পর্যন্ত অঞ্চল জুড়ে দুটি কোম্পানী মোতায়েন করেন।

 কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরে পাকিস্তানী সৈন্যরা অবস্থান গ্রহণ করার পর ভুরুঙ্গামারী থানার ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধাদের পাঠানো হয়। তারা অধিকৃত কুড়িগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী উলিপুরে সাফল্যের সাথে গেরিলা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বেশ কিছুসংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়।

 নবগঠিত বাংলাদেশ বাহিনীর সি-ইন-সি কর্নেল ওসমানী ২৪শে মে ভুরুঙ্গামারী থানা হেডকোয়ার্টার পরিদর্শনে আসেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য এবং কুড়িগ্রাম শহরের সাথেই প্রবাহিত ধরলা নদীর উত্তর তীরস্থ আমাদের প্রতিরোধ ঘাঁটি মজবুত করার জন্য পর্যন্ত ও ভারী অস্ত্র প্রদানের আহবান আমরা জানাই। এর ফলে আমরা ভারত থেকে দুটি এসএমজি ও দুটি ৮১ এম-এম মর্টার পাই। এই অস্ত্র দুটো ধরলা নদীর উত্তর তীরস্থ পাটেশ্বর ডিফেন্স ও কাউয়াহাগা ডিফেন্স ব্যবহার করা হয়। হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে এই অস্ত্র খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত উক্ত এসএমজি দুটো ফেরত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে এসএমজি দুটো তাড়াহুড়ো করে ফেরত দেয়া হয়।

 এদিকে ২৬শে মে পাকিস্তানী সৈন্যরা ভারী কামানের সাহায্যে পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটিতে তীব্র আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরলা তিস্তা নদীর তীর থেকে শেল বর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধরা ভারী অস্ত্রের অভাবে বাংকার থেকে উঠে ভূরঙ্গামারীর দিকে ফিরে আসতে থাকে। মূলতঃ ঐ দিনই পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটি ভেঙ্গে যায়।