পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



২৯০

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০। দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ অঞ্চলে সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ ঠাকুরগাঁ-দিনাজপুর
সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন
১২-৬-১৯৭৪

 ২৫শে মার্চের বিকালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, পিলখানা হইতে প্রেরিত বেতার সংকেত কিছুই আমাদের কানে পৌঁছে নাই। হঠাৎ মাঝরাতে কি এক জরুরী ডাকে আমাদের নবম শাখার ছোট কর্তা ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম এক প্লাটুন লোক নিয়ে দিনাজপুর গেলেন। সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল তারেক রসুল কোরেশীর সঙ্গে কি যেন আলোচনা হইল। ভোর রাত্রে সদলবলে তিনি ফিরিয়া আসিলেন। ২৬শে মার্চের ভোর। আসিয়াই ক্যাপ্টেন ঠাকুরগাঁ হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত তামাম জুনিয়র কমাণ্ডারগণকে অফিসে ডাকিয়া পাঠাইলেন। জরুরী সভা করিয়া সরকারের আদেশ সবাইকে জানাইয়া দিয়া হাজির রিজার্ভ কোম্পানীসহ বাকি সবাইকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ণ সামরিক সাজে সজ্জিত হইতে আদেশ দিলেন। উপস্থিত সকলেই “বহুত আচ্ছা সব” বলিয়া যে যার কাজে লাগিয়া পড়িল।


 এদিকে উইং অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ হুসেন সীমান্ত পরিদর্শনে পঞ্চগড়ের দিকে বাহিরে ছিলেন। তাহাকে বিশেষ করিয়া ডাকিয়া পাঠান হইল। সকলেই রণ সাজে সজ্জিত হইয়া গভীর আগ্রহে বসিয়া আছে। ঠাকুরগাঁ টাউন ততক্ষণে ফাটিয়া পড়িয়াছে, জনতার বান ডাকিয়াছে, রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। ইট পাথর ও অন্যান্য জিনিস দিয়া শত শত গাছ কাটিয়া। উইং হেডকোয়ার্টারে আত্মরক্ষামূলক সামরিক ব্যুহ রচনা করিয়া পাহারার বন্দোবস্ত করা হইল। এমন সময় প্রায় ৯ টার দিকে মেজর আসিলেন, আবার জরুরী সভা বসিল। খামাখাই ছুতানাতায় নেহাৎ ভাল মানুষ বলিয়া সুপরিছিত মেজর বিষম রাগত হইয়া উঠিলেন। সবার প্রতি, আর রিজার্ভ কোম্পানির অধিনায়ক সুবেদার হাফিজকে তো একেবারে হাজতে দিবেন বলিয়া শাসাইলেন। তাহার অপরাধ কোম্পানী রণপ্রস্তুতি নিতে একটু দেরী করিয়া ফেলিয়াছে। মওকা বুঝিয়া ক্যাপ্টেনও এক ধাপ আগ বাড়িলেন-বলিলেন, “ও দিন ভুল যাও -আওয়ামী লীগ-মীগ নেহী চলে গা৷” তাহাদের মনের খবর পাওয়া গেল। আমরা চুপচাপ শুধু নীরব শ্রোতা। দীর্ঘশ্বাসটি পর্যন্ত না ফেলিয়া কাজ করিয়া যাইতে লাগিল আমাদের লোক। তবে বাঙ্গালী সৈনিকদের অবস্থাটা বেশ গভীরভাবে আঁচ করিতে পারিল। ডাক-তার না থারিলেও বাতাস যেন কানে কানে চুপে চুপে সব খবর দিয়া যাইতে লাগিল। এমনিভাবে সমুদয় বাঙ্গালী সৈনিকের মন পুরাদস্তুর বারুদের ঘর হইয়া উঠিল। অপেক্ষা একটু মাত্র ইঙ্গিতের কিন্তু আমি লোকদিগকে সান্তনা দিতে লাগিলাম।


 এদিকে কালবিলম্ব না করিয়াই বড় কর্তার আদেশে টাউনে পেট্রল পাঠানো হইল, আর কারফিউ জারী থাকিল দিন-রাত। কিন্তু হাজার হাজার বিক্ষুদ্ধ জনতা সকল আদেশ অমান্য করিয়া শভাজাত্রা বাহির করে এবং নানা জায়গায় বেরিকেড স্থাপন করিয়া চলিল। মেজর ও ক্যাপ্টেন আমাকে সঙ্গে নিয়া শহরে গেলেন এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে আনিবার চেষ্টা নেন। সেইদিন বেলা দশ ঘটিকার সময় মিছিলের উপর গুলি চালানো হয়। ফলে রিকশাওয়ালা মোহাম্মদ আলী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। আমাদের লোক আরও খাপ্পা হইল; আমি তাহাদিগকে সান্তনা দিয়া আমার কয়েকজন সহকর্মীসহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পরামর্শ করিলাম এবং সকল আলোচনা গোপন রাখা হইল।