পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৯৫

অক্ষরেখা ধরিয়া সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। ৪ঠা এপ্রিল তাহারা ভূষির বন্দরে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। আবার ঐ দিন দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁ ইপিআর, আর্মি, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী নিয়া একটা যৌথ কমাণ্ড গঠিত হইল। আর ভাতগাঁও পুলের নিকট একটি জরুরি সভা ডাকিয়া তাহাতে যৌথ কমাণ্ডের অধীনে সৈয়দপুর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইল।

 ৫ই এপ্রিল ৮ উইং দিনাজপুরের সুবেদার আবদুল মজিদের নেতৃত্বে এক কোম্পানী ইপিআর ৯ উইং-এর একটি ইপিআর প্লাটুনসহ সৈয়দপুর- নীলফামারী সদর রাস্তায় সৈয়দপুরের অদূরে দারোয়ানির নিকট প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। উক্ত তারিখে ভূষির বন্দরে আমাদের সঙ্গে শত্রুদের সংঘর্ষ হয় এবং তাহারা পালাইয়া যায়। সেইদিনই আমাদের বাহিনী একনাগাড়ে প্রায় ১০ মাইল আগাইয়া চম্পাতলী নামক স্থানে গিয়া পৌঁছে। তখন রাত্রি ১১টা। একেত অপরিচিত স্থান, তদুপরি গাঢ় অন্ধকার ও মুষলধারে বৃষ্টি। যাহা হউক ভোর পর্যন্ত প্রতিরক্ষার অনেকটা ব্যবস্থা হইয়া গেল। কিন্তু ৬ই এপ্রিলের সূর্য উঠিতে না উঠিতেই দুশমনরা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। তারপর ‘ইয়া আলী' হুঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইপিআর ও রেজিমেণ্টের জোয়নরা মিলিতভাবে পাল্টা ‘ইয়া আলী' বলিয়া সিংহনাদে দুশমনের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে। বঙ্গশার্দুলের থাবায় নয়জন খানসেনা প্রাণ হারায়, বাকী ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় প্রাণ নিয়া পলাইয়া যায়। খানিক পরে ক্যাপ্টেন আশরাফ পরামর্শ সভা ডাকিলেন, জানা গেল তার কাছে গোলাবারুদ একেবারেই কম, কোনমতে সেদিনকার মত চলিতে পারে। তিনি সেইদিনই সন্ধ্যা পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ততক্ষণ আর অপেক্ষা করিতে হইল না। হঠাৎ করে শুরু হইল শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনীল অজস্র শেলিং, পিছনে আসিল কয়েকটি ট্যাঙ্ক, সঙ্গে ৮১ মিলিমিটার মর্টার। অনেকক্ষণ সংঘর্ষ চলিল। উভয় পক্ষেই হতাহত হইল এবং ছত্রভঙ্গ হইয়া অনেক লোক দলত্যাগী হইবার সুযোগ পাইল। আমরা ভূষির বন্দর প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে পজিশন নিলাম। পরদিন সেখানে তুমুল যুদ্ধ হইল। আমাদের নিকট ভারী এবং প্রতিরোধক অস্ত্র না থাকায় আবার পশ্চাতে আসিতে বাধ্য হইলাম।

 এই সময় সুবেদার হাফিজ কোম্পানীর অধিকাংশ দেবীগঞ্জ হইয়া খানসামায় প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে। ওদিকে নীলফামারী রাস্তায় মজিদ কোম্পানীর সঙ্গে ৭ এবং ৮ এপ্রিল দুশমনদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। সেখানে আমাদের তিনজন শহীদ কয়েকজন আহত ও বহু হাতিয়ারপত্র খোয়া গেলেও দুশমনরাও বিশ-পঁচিশ জন হতাহত নিয়া অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইখানেও ট্যাঙ্ক এবং গোলন্দাজ হামলার মোকাবিলা করিতে না পারিয়া ক্যাপ্টেন আশরাফ, সুবেদার মেজর আব্দুর রব, ক্যাপ্টেন নজরুল হক এবং আমার উপস্থিতিতে ৪ঠা এপ্রিল ভাতগাঁয়ে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা আমাদের কাজ চালাইয়া যাইতে লাগিলাম এবং পিছনে হাটিয়া দশ মাইল ষ্ট্যাণ্ডে শক্ত করিয়া ঘাঁটি গাড়িলাম।

 ১০ই এপ্রিল সকাল ৯ ঘটিকায় শত্রুরা ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ বহর নিয়া আমাদের উপর ভীষণ আক্রমণ চালাইল। প্রথম বার আমরা তাহাদের আক্রমণ প্রতিহত করিলাম। দ্বিতীয় বার বেলা ২ ঘটিকার সময় আক্রমণ চালায়। শত্রুপক্ষের গোলার আঘাতে আমাদের দুইটি ছয় পাউণ্ডার গান-ই নষ্ট হইয়া যায়। তুমুল যুদ্ধের পর এখানে আমাদের চারজন লোক শহীদ হয় এবং কিছু লোক আহত হয়। ফলে আমাদের লোক দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া দিনাজপুরের লোক দিনাজপুরের দিকে ঘাঁটি পরিবর্তন করে ও ঠাকুরগাঁয়ের লোক ভাতগাঁও পুলের নিকট দৃঢ় অবস্থান নেয়। দশ মাইল স্ট্যাণ্ডের যুদ্ধে আমাদের ভীষণ ক্ষতি হইল, কেননা বাহির হইতে অনেক গোলাবারুদ আমরা এখানে আনিয়া জমা করিয়াছিলাম এবং আমাদের কাছে থাকা কয়েক শত রাইফেল বন্দুকও সেখানে রাখা ছিল। সকলেরই ধারণা ছিল আমাদের এই স্থান ছাড়িতে হইবে না কিন্তু ট্যাঙ্ক বহরের আক্রমণের