পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৯৭

বর্বর পশুরা তাহাকে গুলি করিয়া মৃত মনে করিয়া পুকুরে ফেলিয়া দেয়। স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতায় এবং তাহাদের প্রাণভরা সেবা ও দয়া ময়ের কৃপায় সে সুস্থ হইয়া উঠে ও অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি তেতুঁলিয়াতে আমাদের সাথে যোগদান করে। বাকী দুইজন শাহাদৎ বরণ করিয়া অমর হইয়া আছেন।

 অন্যদিকে খানসামাতে ১৩/১৪ তারিখের সংঘর্ষে হাফিজ কোম্পানী পাক আর্মিকে তিনদিন পর্যন্ত জব্দ করিয়া রাখিলেও আমাদের ভাগ্যলক্ষ্মী প্রসন্ন ছিল না। একেত খানরা মার খাইয়া ততক্ষণে ভারী মর্টার ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়া আসিল, তদুপরি সেইদিন একই সময়ে খবর পাওয়া গেল ভাতগাঁয়ের প্রধান প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। তাই ডি কোম্পানীও খানসামা ছাড়িয়া চলিয়া আসিল। তবে এই কোম্পানী ঐ স্থানে মোতায়েন থাকায় ভাতগাঁও শত্রুর পাশ অথবা পশ্চাৎ আক্রমণ হইতে নিশ্চিতভাবে রক্ষা পাইয়াছিল।

 এই কোম্পানীর পশ্চাদপসরণের সঙ্গে সঙ্গে জয়গঞ্জ, ঝারবাড়ী, দেবীগঞ্জ প্রভৃতি স্থানের ছোট ছোট রক্ষাব্যূহগুলিরও পিছু হটিতে বাধ্য হইল। এইভাবে শত্রুসেনার অগ্রাভিযান আর আমাদের পশ্চাদপসরণের পালা চলিতে থাকিল। তবে সান্ত্বনা এই হতাহতের দিক দিয়া শত্রুসংখ্যা বরাবরই ভারী ছিল। আমরা দিনব দিন হাতিয়ার আর গোলাবারুদ হারাইয়া দুর্বল হইতে থাকিলাম- স্বাধীন এলাকার পরিধিও কমিয়া আসিতে লাগিল, জনসাধারণের মনোবল ভাঙ্গিয়া পড়িল- খাদ্য সরবরাহও আমাদের প্রায় বন্ধ হইয়া আসিল। আমরা প্রমাদ শুনিলাম এবং আরও পিছে হটিয়া আসিলাম।

 প্রায় ২০/২১ দিন মুক্ত থাকার পর ঠাকুরগাঁয়ের পতন হইল। স্থানীয় জনসাধারণ শহর ছাড়িয়া গ্রামে ও ভারতে আশ্রয় নিতে লাগিল। সামরিক নিয়মে সামরিক বাহিনী কোন স্থান ছাড়িয়া দেয় আবার কোন স্থান দখল করে এবং তাহা পরিকল্পনা মাফিক হইয়া থাকে। আমাদেরও তেমন পরিকল্পনা ছিল কিন্তু আমার অনুপস্থিতিতে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হইতে পারে নাই। যাহা হউক, যতদূর সম্ভব গোলাবারুদ, রেশনপত্র সঙ্গে নিয়া গিয়াছি কিন্তু আরও সরকারী বেসরকারী জিনিস নেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিৎ ছিল। মেজর এম, টি হোসেনের অনুপস্থিতিতে আবার আমাকেই দায়িত্বভার নিতে হইল। আমি সুবেদার হাশেম, নায়েক সুবেদার মতিউর রহমানকে আরও ২২ জন লোকসহ মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়া ঠাকুরগাঁ পাঠাইলাম ব্যাঙ্কের টাকা পয়সা ও মূল্যবান গহনাপত্র যাহা পাওয়া যায় তাহা নিয়া আসার জন্য। তাহারা ঠাকুরগাঁ আসিয়া স্টেট ব্যাঙ্কের সীলমোহর যুক্ত একত্রিশ বাক্স টাকা লইয়া পঁচাগড়ে ফিরিয়া আসিয়া একটি গাড়ীতে বোঝাই অবস্থায় আমার কাছে অর্পণ করে। আমি ১২ জন লোকের একটি গার্ড দিয়া রেশনের গাড়ীতে ঐ গাড়ীটিও রাখিয়া দিই। কিছু দিন পরে এই টাকা ক্যাপ্টেন নজরুল, জনাব সিরাজুল ইসলাম এমসিএ, জনাব আবদুর রউফ এমসিএ-দের উপস্থিতিতে কর্নেল ব্যানার্জীর হেফাজতে রাখি এবং পরে অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী সাহেব স্বয়ং আসিয়া ঐ টাকা মুজিবনগরে নিয়া যান। আমিও তাঁহার সঙ্গে যাই টাকা জমা দিতে। সেখানে প্রায় ১ কোটির মত টাকা ছিল যাহার হিসাব অর্থমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়।

 ১৭ই এপ্রিল নাগাদ আমাদের কোম্পানীগুলি বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হইতে পঞ্চগড়ে আসিয়া পৌঁছিল। তাহারা পরস্পরের সহযোগিতায় সেখানে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করিতে শুরু করিল। ১৭ এবং ১৮ তারিখ বিভিন্ন কোম্পানীর বেশ কিছু লোক যাহারা নানাস্থানে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল অথবা আটকা পড়িয়াছিল পঞ্চগড় আসিয়া উপস্থিত হইল। আমাদের লোক নতুন উৎসাহ নিয়া কাঞ্চন নদীর তীরে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণে তৎপর হইল। ১৮ তারিখ ছোট ছোট কয়েকটি দল আগে পাঠাইলাম, অনেক দূর আগাইয়াও শত্রুর কোন আনাগোনা দেখা গেল না। আমাদের প্রায় ১০৬ টি পরিবার ছেলেমেয়েসহ ছিল। এই সুযোগে তাহাদিগকে সরাইয়া নিরাপদ স্থানে নিবার ব্যবস্থা করিলাম। চিকিৎসাধীন কিছু রোগী এবং আহতকেও হাসপাতালে স্থানান্থরিত করা হইল। এই সময় আমাদের কাছে কোন ডাক্তার ছিল না। একমাত্র কম্পাউণ্ডার মনসুরই ছিল আমাদের প্রধান অবলম্বরন এবং তাহার সঙ্গে কয়েকজন নার্স ছিল। কম্পাউণ্ডার মনসুর বিপদের সময় যে কাজ করিয়াছেন, যেভাবে রোগীদের সেবাযত্ন নিয়াছেন তাহা সত্যিই প্রশংসনীয়।