পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩০৮

নিরস্ত্র করে ঠাকুরগাঁ জেলখানায় পাঠিয়ে দেই। থানার বাঙ্গালী সিপাহীরা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সহযোগিতা করে। এপ্রিলের প্রথমেই থানা ক্যাম্পাসে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, ইপিআর ও পুলিশ একযোগে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কাজ করে। ঠাকুরগাঁ উইং হেডকোয়ার্টার থেকে বাঙ্গালী ইপিআরগণ তাদের অস্ত্রাদি নিয়ে পঁচাগড় চলে আসেন। থানার রাইফেলগুলো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দেয়া হয়। পচাঁগড় থানা ক্যাম্পাসে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার ব্যাপারে আমি নিজেও সক্রিয় ছিলাম। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু ছিল।

 এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে দিনাজপুর- পঁচাগড় রাস্তায় ভাতগাঁও নামক স্থানে একটি পুলে পাকিস্তানী সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র- জনতা ছিল। সৈন্যদের ভারী অস্ত্রের মোকাবেলা করতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে এসে পঁচাগড়ে ডিফেন্স দেয়। উদ্দেশ্য, পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে পঁচাগড় প্রবেশে বাধা দেয়া। ঐ সময়ই নিরাপত্তার জন্য আমি আমার পরিবারের লোকজনকে ভারত সীমান্তের কাছে ভিতরগড় নামক স্থানে স্থানান্তরিত করি। আমি নিজে পঁচাগড়েই অবস্থান করতে থাকি।

 ২১শে এপ্রিল সৈন্যরা গোলাবর্ষণ করতে করতে পঁচাগড়ে ঢুকে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সংঘর্ষ হবার পর সৈন্যরা পঁচাগড় থানা বাজারটি সম্পূর্ণ পুড়িয়া দেয়। বহু লোক মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রুপ হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভারতে প্রবেশ করে।

মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর[১]

 গভীর রাত্রিতে ওরা দিনাজপুর শহরে এসে ঢুকল। এ রাত্রি সেই ২৫-এ মার্চের রাত্রি, যে রাত্রির নৃশংস কাহিনী পাকিস্তানের ইতিহাসকে পৃথিবীর সামনে চির-কলঙ্কিত করে রাখবে।

 ওরা সৈয়দপুর থেকে এসে অতি সন্তর্পণে শহরের মধ্যে ঢুকল। শখানেক পাঞ্জাবী সৈন্য। শহরে ঢোকার মুখে প্রথমেই থানা। সৈন্যরা প্রথমে থানা দখল করে নিয়ে সেখানে তাদের ঘাঁটি করে বসল। তারপর তারা তাদের পূর্ব- নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে শহরের টেলিগ্রাম ও টেলিফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। সেইদিনই শেষ রাত্রিতে দিনাজপুরের বিখ্যাত কৃষক নেতা গুরুদাস তালুকদার এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দু নাগরিক তাদের হাতে গ্রেফতার হলেন। এমন নিঃশব্দে ও সতর্কতার সঙ্গে এ সমস্ত কাজ করা হয়েছিল যে, শহরের অধিকাংশ লোক তার বিন্দুমাত্র আভাস পায়নি। পরদিন সকাল বেলা তারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে জানল, পাকসৈন্যরা তাদের দিনাজপুর শহর দখল করে নিয়েছে। আরও শুনল, বেলা ১১টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ আদেশ ঘোষণা হচ্ছে। দিনরাত অষ্টপ্রহর ধরে কারফিউ চলবে। শহরের রাজপথ জনশূন্য, কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া শব্দ নেই। সবাই যে যার ঘরে মাথা গুজে বসে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জল্পনা- কল্পনা করে চলেছিল। সারাটা দিন এইভাবে কাটল কিন্তু রাত্রি বেড়ে উঠার সাথে সাথে এই ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলির মনের পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল, তারা মাথা তুলে উঠে দাঁড়াল। শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা” ধ্বনি শোনা যেতে লাগল। শহরে যে- সব জায়গায় মেহনতী মানুষদের বাস, সেই সব জায়গা থেকেই সবচেয়ে বেশী আওয়াজ উঠছিল। দম বন্ধ করা সেই ভয় ও দুর্ভাবনার বোঝাটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মানুষ প্রাণ খুলে তার প্রাণের কথা বলতে চাইছিল। রেল চলাচল, ডাক, টেলিগ্রাফ, সবকিছু বন্ধ অথচ খবরগুলি যেন বাতাসে উড়ে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কেমন করে সেই সমস্ত সংবাদ এল কেহই তা স্পষ্ট করে বলতে পারে না, কিন্তু ২৭তারিখের মধ্যেই এ কথাটা মোটামুটি সবাই জেনে ফেলেছে যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। শহরের লোকদের চাঞ্চল্য আর উত্তেজনা তাদের ভয়কে ছাপিয়ে উঠেছে। এটা সবাই তীব্রভাবে অনুভব করছে যে, এই মুক্তিসংগ্রামে সকলেরই যোগ দেওয়া উচিত, কিন্তু সাধারণ মানুষ, নিরস্ত্র মানুষ, তারা কি করে জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে।


  1. 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ” থেকে সংকলিত।