পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩২৩

 ২৭শে মার্চ আনুমানিক বেলা ১১ টার সময় আমাকে পুলিশের অয়ারলেসযোগে রাজশাহীর ডিসি ডাকেন। তার সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন যে; রাজশাহী পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট ঘেরাও করে আছে এবং পুলিশদের আত্নসমর্পন করতে আদেশ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কেউই আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত নয়। তিনি এবং এসপি তাদের সাথেই আছেন। যদি সম্ভব হয় কিছু ইপিআর-কে এর লোক যেন সাহায্যে এগিয়ে আসে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আর আধঘণ্টা সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে পুলিশ লাইনের উপর আক্রমন চালাবে এবং তার মর্টর ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু আমি তাকে বললাম কি করে এত অল্প সময়ের মধ্যে ৬০ মাইল কাচা রাস্তা (নাওগাঁ থেকে রাজশাহী) যাওয়া সম্ভব? এ কথা শেষ হতে না হতে ডিসি অয়ারলেস ছেড়ে দিলেন এবং আমি অপারেটরের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে বলছিল; গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে-এরপর আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অনেক চেষ্টার পরও কোন খরব পাওয়া গেল না। এ দিকে আমরা খবর পেলাম যে বগুড়ার আর্টিলারী রেজিমেণ্ট-এর একটা ব্যাটারী আছে যেটাকে এখন অভ্যান্তরীন নিরাপত্তা ডিউটির জন্য মুভ করানো হয়েছে এবং তারা সেখানকার গালর্স স্কুলে অবস্থান করছে।

 প্রতিরোধের পরিকল্পনা: আমি মেজর নজমুল হক সহ পরিকল্পনা করলাম যে ২৮শে মার্চ প্রথমতঃ এক কম্পানী ইপিআর ফোর্স নাটোরের রাস্তা দিয়ে সারদায় পাঠাব ক্যাডেট কলেজের এ্যাডজুট্যাণ্ট মেজর রশিদের কাছে। এবং রংপুর থেকে রাজশাহী যাবার রাস্তা বগুড়ায় বিচ্ছিন্ন করে দেব। অন্যথায় মেজর রশীদ তার ফোর্সসহ ঢাকা থেকে রিইনফোর্সমেণ্ট নিয়ে রাজশাহী আসার রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে দেবে।

 ২৮শে মার্চ বিকেলে আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার লোকজন নিয়ে বগুড়ায় পৌছে গেলাম যার দুরত্ব আনুমানিক ৩০ মাইল। কিন্তু রাস্তায় ব্যারিকেড থাকাতে আমাকে সকাল দশটায় রওয়ানা হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় পৌছতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখি শহরের লোকজন নেই বললেই চলে। সব মিলে হাজার খানেক লোক হবে কি না সন্দেহ। পরিবার বলতে কারুরই ছিল না। একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল এবং গাড়ীর আওয়াজ শুনে এবং লাইট দেখে সবাই পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগেও এখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে স্থানীয় লোকের সামান্য গোলাগুলি হয়েছিল; সন্ধ্যা হতে না হতেই শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল এবং শহরের রাস্তাগুলো ছিল ব্যারিকেডপূর্ণ।

 বগুড়ায় সংঘর্ষঃ আমি প্রথমে পুলিশ লাইনে গেলাম। সেখানে একজন বেশ সাহসী রিজার্ভ পুলিশ ইন্সপেক্টার এবং শ” দুয়েক পুলিশ দেখতে পেলাম। আমাদেরকে দেখতে পেয়ে তারা অনেকটা সাহস পেল এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমাদেরকে জ্ঞাত করল। আমি জানতে পারলাম যে তারা (আর্টিলারী ব্যাটারী) আপাততঃ রংপুর থেকে কোন ফ্রেশ সাপ্লাই পাচ্ছে না যেহেতু রাস্তাঘাট বন্ধ। তবে তারা প্রায়ই গ্রামের পথে গাড়ী নিয়ে যায় এবং তরিতরকারী এবং মাংস সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। আমার জানা ছিল যে আর্টিলারী ব্যাটারীতে ৫০/৬০ জনের বেশী লোক হতে পারে না এবং তাদের ততোটা সম্মুখ সমরে অবতীর্ন হবার নিপুণতা নেই। সেই হেতু প্রথমতঃ পরিকল্পনা করলাম যে গ্রামে যাবার পথে অথরা পেট্রলিং-এর সময় তাদেরকে এ্যামবুশ করা সহজসাধ্য হবে।

 পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯/৩০শে মার্চ রাতে একটাএ্যামবুশ পার্টি পাঠালাম। এতে ছিল নওগাঁ থেকে আসা কয়েকজন ছাত্র ও ইপিআর ও পুলিশের লোকজন। তিনখানা ৩ টনী গাড়ীসহ সেনাবাহিনীর কয়েকজন কমপক্ষে এক প্লাটুন পেট্রলিংয়ে বের হয় এবং রাস্তার মধ্যে আমাদের লোকজন তাদের কে এ্যামবুশ করে। তিনটা গাড়ি বিধ্বস্ত হয়। তিনটা অয়ারলেস সেট দখল করা হয় এবং ২৩জন নিহত হয়। বাকি লোক ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় রংপুরের দিকে পশ্চাদপসরন করে। এই এ্যামবুশে আমাদের সৈনিকদের মনোবল অনেক বৃদ্ধি পায়।

 বগুড়াতে তখন একটা এ্যামুনিশন ডাম্প ছিল; যেটা একজন ক্যাপ্টেন কমাণ্ড করছিল। ওখানে মাত্র ২০/২৫ জন সৈনিক প্রহরা দিচ্ছিল। আমি সবাই কে একত্রিত করে কিভাবে এ্যামুনেশন ডাম্প দখল করতে হবে; বিশেষ