পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩২৭

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেড সৈন্য আমার সৈন্যদের ওপর ঝঁপিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমার সৈন্যদের অপসারিত করা হয় এবং তারা নওয়াবগঞ্জের দিকে সরে আসে।

 নওয়াগঞ্জের প্রতিরোধঃ বেলা প্রায় দুই ঘটিকায় সময় আমি আমার এক হাজার সেনাবাহিনীর মধ্যে মাত্র ৩ শত জনকে খুঁজে পাই এবং তাদের নিয়ে রাজশাহী এবং নওয়াবগঞ্জের মাঝখানে গোদাগাড়ী নামক স্থানে আমার প্রতিরক্ষা ব্যূহ পুনরায় তৈরি করি। এটা রাজশাহী থেকে ১৮ মাইল এবং নওয়াবগঞ্জ থেকে ১২মাইল দূরে ছিল। রাজশাহীর যুদ্ধে আমার ৩৫/৪০ জন নিহত হয়। এতে আমার সৈন্যদের মনোবল একেবারে ভেংগে পড়ে।

 আমার সাথে নুরুল ইসলাম নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ১৫ই এপ্রিল সে ভারতে চলে যায় এবং ১৬ তারিখ সে আমাকে এসে খবর দেয় যে মুর্শিদাবাদ জেলার জেলা প্রশাসক এবং বিএসএফ-এর কমাণ্ডার আমার সাথে জরুরী কাজে দেখা করতে চান এবং তিনি আমাকে সাহায্য দিতে প্রস্তুত আছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নুরুল ইসলাম নামের সেই ছাত্রটির সাথে ১৬ই এপ্রিল মুর্শিদাবাদে ওদের সাথে দেখা করতে গেলাম। কিন্তু এতে কোন ফলই হল না। কোন সাহায্যই পাওয়া গেল না। নিরাশ হয়ে ফিরে আসলাম।

 ১৭ই এপ্রিল সকালের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের অবস্থানের উপর এবং নওয়াবগঞ্জ শহরের উপর হামলা চালাল। জংগী বিমানের সাহায্যে রকেট এবং মেশিনগানের প্রচণ্ড হামলা চালায়; কিন্তু আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেংগে নওয়াবগঞ্জ পৌঁছতে তখনও সক্ষম হয়নি।

 ২১শে এপ্রিল খুব ভোরের দিকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু হল আমাদের অবস্থানের উপর এবং শত্রুবাহিনী আক্রমন চালাল। আমাদের প্রতিরক্ষ্যা বৃহৎ শত্রুবাহিনী ভেদ করতে সক্ষম হল বেলা দশটার দিকে। প্রতিরক্ষা ব্যূহের নিকটেই ছিল পদ্মা নদী। সেখানে আমার সাবেক ইপিআর- এর দু খানা স্পীড বোট ছিল; যাতে করে আমি লড়াই চলাকালে ভোরের দিকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ নদী পার করে বাংলাদেশের ভেতরেই চর এলাকায় পৌঁছে দিয়েছিলাম। শত্রুবাহিনী ত্বরিত গতিতে নওয়াবগঞ্জসহ প্রায় সমস্ত এলাকাই; নওয়াবগঞ্জের চর এলাকা ছাড়া শত্রুকবলিত হয়। সেখানেই আমার সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি।

 ক্ষোভে; দুঃখে এবং হতাশায় আমি যখন নিমজ্জিত তখন বিএসএফ-এর কয়েকজন লোক আমাকে খবর দিল যে; আমাকে মেজর দারাস বলে একজন অফিসার আমার সাথে দেখা করতে চান। অগত্যা তার সাথে দেখা করতে গেলাম। সে আমাকে বললো; আমি যেন আমার সমস্ত জিনিস এবং অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদসহ লালগোলায় (মুর্শিবাদ) পৌঁছে যাই। ২২শে এপ্রিল আমি আমার তিন হাজারে উপর রাইফেল; স্টেনগান; এল-এম-জি এবং গোলাবারুদ নিয়ে লালগোলায় পৌঁছালাম। পৌঁছুতে না পৌঁছুতে বিএসএফ- এর দু'খানা ট্রাক এসে আমাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ নিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে গেল। তবে সামান্য কিছু রাইফেল আমাদের কাছে রেখে গেল।

 এদিকে আমাকে খবর দেয়া হল যে কর্ণেল ওসমানী আমাদের সাথে বালুর ঘাটে (দিনাজপুর) ২৩শে এপ্রিল দেখা করতে চান। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা সেখানে পৌছলাম এবং এই প্রথম এম-সি এর সাথে দেখা হয়। কর্নেল ওসমানী সেদিন আমাকে সে এলাকার অধিনায়ক নিযুক্ত করেন এবং বলেন যে বিএসএফ আমাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ খাদ্য প্রভৃতি দিয়ে সাহায্য করবে।