পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৩০

ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অনেক মুক্তিসেনা শাহাদৎ বরন করেন। বানেশ্বর এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে সারদার পতন হয়। সারদায় পাক আর্মি চলে আসায় বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর প্রায় ১৫০০/২০০০ লোক নদীর ধারে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকসেনারা তাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং ৭০০/৮০০ লোককে নৃশংসভাবে গুলি করে পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। ওই দলের মধ্যে থেকে আমরা মাত্র তিন-চারজন বেঁচে ছিলাম। পাক সেনাবাহিনী সন্ধ্যার দিকে রওনা হয় এবং রাজশাহী দখল করে নেয়।

সশস্ত্র প্রতিরোধ-রাজশাহী-বগুড়া-পাবনা

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার খোন্দকার মতিউর রহমান বীর বিক্রম

২৪-১২-১৯৭৩

 ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় উইং কমাণ্ডার অভ্যান্তরীণ নিরাপত্তা ডিউটির জন্য তিনটি প্লাটুন তৈরি করে রাখার নির্দেশ দেন। রাত আট ঘটিকার সময় উইং হাবিলদার মেজর সৈয়দুর রহমান (পাঠান) কে পুরো উইংকে ফল ইন করার নির্দেশ দেয়া হয়। তখন তিনটি প্লাটুন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকে।

 ২৬শে মার্চ সকাল বেলায় কোয়ার্টার গার্ড কমাণ্ডার মুজিবর রহমান বাংলাদেশে পতাকা কোয়ার্টার গার্ডে গার্ড অব অনার দিয়ে উত্তোলন করে। ২৬শে মার্চ সকাল ৭ঘটিকার সময় মেজর নজমুল হক; ক্যাপ্টেন গিয়াস; মেজর আকরাম ও ক্যাপ্টেন নাবিদ আফজাল উইং-এ আসেন এবং সুবেদার মেজর আবদুল লতিফ মোল্লাকে পুরো উইংফল-ইন করার নির্দেশ দেন। ফল ইন করা হয়। মেজর নজমুল হক বললেন যে, যা করার আমি সব করব।

 ২৬শে মার্চ সকাল ৮/৯টার সময় ১০০থেকে ১৫০জন লোক মাইক নিয়ে আমাদের অফিসের সম্মুখে এসে ৭ই মার্চে শেখ সাহেবের টেপ রেকর্ডকৃত ভাষণ বাজাতে শুরু করে এবং শ্লোগান দিতে থাকে। মেজর নজমুল হক অফিসের সম্মুখে হৈচৈ গণ্ডগোল না করার জন্য জনতাকে নির্দেশ দেন। আনুমনিক ১০/১১টার সময় কোয়ার্টার গার্ডের সেণ্ট্রির উপর হঠাৎ একটি গুলি আসে। এটা শোনার পর চতুর্দিক থেকে ফাঁকা আওয়াজ শুরু হয়। ১০ মিনিট গোলাগুলি চলে। উল্লেখ্য যে ২৫শে মার্চ রাতে আমরা তিনটা বাংগালী প্লাটুনকে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত করে রাখি (ক্যাপ্টেন গিয়াসের গোপন নির্দেশে) মারত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে আশংকায়। ক্যাপ্টেন গিয়াস আমাকে এবং সুবেদার মনোয়ার আলীকে অফিসে ডেকে গোপনে বলেন যে; বাঁচার জন্য আপনারা তৈরি থাকুন ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ। এই কথা বলে তিনি ভেংগে পরছিলেন। গোলাগুলীর পর মেজর আকরাম বেগ মেজর নজমুল হককে অনুরোধ করেন যে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরকে যেন তিনি একটা ব্যারাকে হেফাজতে রাখেন। তখন সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরকে একটি ব্যারাকে প্রহরী মোতায়েন করে রাখা হয়। তাদেরকে ব্যারাক থেকে বের হয়ে না আসতে নির্দেশ দেয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের পরিবারবর্গকে জেসিও মেসে রাখা হয় এবং বাংগালী ইপিআর তাদের পাহারা দেয়। মেজর নজমুল হকের নর্দিশে তাদের অস্ত্রশস্ত্র অফিসে জমা করানো হয়। অফিসের চতুর্পার্শ্বে বাংগালী ইপিআর প্রহরী লাগানো হয়। বেলা বারটা-১টার সময় বিপুল জনতা অফিসের সামনে হাজির হয়। তারা ক্যাপ্টেন গিয়াসকে বলে যে; শান্তাহারে বিহারী অস্ত্র নিয়ে বোয়ালিয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আপনারা এগিয়ে আসুন।

 ২৭শে মার্চে মেজর নজমুল হকের নির্দেশে তিনটি প্লাটুন তিনটি অয়ারলেস সেট সহ শান্তাহার অভিমুখে আমার নেতৃত্বে রওনা হয়। শান্তাহারে দেখি চারিদিকে শুধু ধোয়া আর আগুন; গোলাগুলীর আওয়াজ। আমি অয়ারলেসে নওগাঁতে মেজর নজমুল হকের সাথে যোগাযোগ করি; বাঙ্গালী ও বিহারী বহু মৃতদেহ উদ্ধার করি এবং পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্তে নিয়ে আসি। মেজর নজমুল হক ১৪৪ ধারা জারী করেন। সীমান্তের বিওপিগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বন্দী করে রাখা হয়েছিল।