পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৩৭

পথে পথে ঘুরে প্রতিরোধ সংগ্রামের আওয়াজ তুলেছে। সেই আওয়াজে ঘরের মানুষ ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছে।

 শত্রুদের প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু প্রতিরোধ করার মত অস্ত্র কোথায়? ছাত্রেরা দল বেঁধে থানায় গিয়ে সেখান থেকে সমস্ত রাইফেল বের করে নিয়ে এল। শুধু তাই নয়; শহরে যার যার হাতে যত বন্দুক ছিল; তোর সবাই তাদের হাতে চলে এসেছে। এ অবস্থায় কোন দিকে থেইে তারা ভাধা বা আপত্তি পায়নি। সবাই যে যার বন্দুক তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। ছাত্রেরা সেই সমস্ত অস্ত্র নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। এই ক'দিনে তারা রাইফেল চালানোর ব্যাপারে যে ট্রেনিং পেয়েছে তা মোটেই আশাপ্রদ নয়। তা হোক; সংগ্রামে নেমে এসেছে; এখন আর অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনার সময় নেই, তাদের যতটুকু বিদ্যা সেই টুককেই কাজে লাগাতে হবে।

 সারা শহরের পথি বহু ব্যারিকেড গড়ে উঠেছে। এই ব্যারিকেড গড়ে তোলার ব্যাপারে শত শত হাত অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছে। ছাত্র আর শ্রমিকরা সবাইর আগে; সাধারণ মানুষও তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে। বড় বড় গাছ কেটে শহরের প্রবেশ মুখ-বন্দ করে দেয়া হচ্ছে। কাজের বিরাম নেই। এইভাবে রাত কেটে গিয়ে ভোর হয়ে এল; তখনও কাজ চলছে। হ্যা; সকল দিক দিয়ে ওদের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিত হবে; ওদের আক্রমণকে অচল করে ফেলতে হবে।

 সৈন্যরা মহাস্থানগড় হয়ে বগুড়া শহরের দিকে মার্চ করে চলে আসছিল। ওরা সকালবেলা বগুড়া শহরের সামনে এসে পৌছল। শহরে ঢোকার একমাত্র পথ সুবিলখালের পুল। ওরা সেই পথ দিয়েই চলে এল। ছাত্র আর শ্রমিকরা সেখানে হানাদার শত্রু সৈন্যদের দৃষ্টির আড়ালে পজিশন নিয়ে দাড়িয়েছিল। সৈন্যরা ব্যারিকেড সরিয়ে ক্রমে ক্রমে এগিয়ে আসছিল। গোপন আশ্রয়ের আড়াল থেকে ছাত্র আর শ্রমিকরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল। হানাদার সৈন্যরা কালিতলাহাট হয়ে ঝাউতলা রোড ধরে বড়গোলা মোড়ে আসে। এখানে আগে থেকেই অনেক ছত্র পজিশন দাঁড়িয়েছিল। সৈন্যরা এখানে এসে পৌছবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল গুলিবর্ষনের সম্মুখীন হোল। ফলে এখানে একজন কর্ণেলসহ ১১জন সৈন্য মারা যায়। সৈন্যরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। একই ভাবে পাক সৈন্যরা অনেকক্ষণ ধরে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে গুলি চালিয়ে যেতে থাকে। বেলা যখন সাড়ে বারোটা তখন স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র টিপু শত্রুসৈন্যের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে মাড়া যায়। দুটি ইউনাইটেড ব্যাংক অফিসের দোতলায় দাঁড়িয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। মাত্র পনের বছর তার বয়স। বগুড়া শহরের স্কুলের ছাত্রদের সে ছিল নেতা। সবাই তাকে চিনত জানত; সবাই তাকে ভালবাসত। গত এক মাসের মুক্তি আন্দলোনে অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাহসের পরিচয় দিয়ে সে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে নিয়েছিল। বীর কিশোর টির যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিল। শুধু সে-ই নয় তারই মত বগুড়ার আরও কয়েকটি বীর সন্তানকে সেদিন এই মুক্তিসংগ্রামে প্রাণ দিতে হয়েছে।

 আজাদুর রহমান নামে এক তরুন ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং বিল্ডিং-এ আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করছিল। শত্রুদের গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে যায়। আজাদ একটি প্রেস চালাত; তারই সাথে সাথে লেখাপড়াও করত। বগুড়ার মানুষ এই সমস্ত বীর শহীদের কথা ভুলে যেতে পারেনি। আরও একজন শহীদের নাম এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। তার নাম হিরু। এই হিরুও সেদিন তাদের মত যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছিল। হিরু কিন্তু একজন বিহারীর সন্তান। বগুড়ার বিহারী কলোনীতে তার জন্ম; সেইখানেই সে বাস করত। তাহলেও জন্মভূমি বাংলাদেশকে সে তার মাতৃভূমি বলে মনোপ্রাণে গ্রহন করে নিয়েছিল এবং এই মাতৃভূমির মুক্তিসংগ্রামে সে শাহাদৎ বরণ করল। বিহারী কলোনীর মধ্যেই হিরুর মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়।

 টিটু, আজাদুর রহমান ও হিরুর মৃত্যুর পর পাক সৈন্যরা দু'ভাগে ভাগ হয়ে দক্ষিণ দিকে এগুতে থাকে। একদল ঝাউতলার মধ্যে দিয়ে যায়; আর একদল যায় রাজাবাজার দিয়ে। এরা রেল লাইনের কাছে এসে গেলে ছাত্ররা ওদের চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এইভাবে আক্রান্ত হয়ে সৈন্যরা বেলা দেড়টার