পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৪১

 “না তা চলবে না।” ডঃ জাহিদুর রহমান রীতিমতো ক্রুদ্ধ। মামুদুল হাসান খানকে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পাঠিয়ে ডাঃ জাতিদুর রহমানসহ দু'খানা সাইকেলে ছুটলাম পুলিশ লইনের দিকে। পথে দেখা করলাম জেলা প্রশাসক খানে আলম খান সাহেবের সঙ্গে; দেখলাম ভীষণ উদ্ধিগ্ন। বললেন সম্মুখযুদ্ধে ওদের সাথে পারবেন না। গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিন। আপনদের সাফল্য কামনা করি ।  এরপর পুলিশ লাইন। পুলিশ লাইনের মকবুল সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। জানালেন অয়ারলেসে কুষ্টিয়া ছাড়া আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। কুষ্টিয়ার শেষ খবর হানাদার বাহিনী কুষ্টিয়া আক্রমণ করেছে। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

 রিজার্ভ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে পুলিশ লাইনে কিছুক্ষণ আলোচনা হলো। স্থির হলো ট্রেঞ্চ খুঁড়ে পুলিশ লাইনে তারা প্রস্তুত থাকবেন। সেকেণ্ড লাইন অব ডিফেন্স।

 শহরে যখন ফিরে আসি তখন সকাল সাতটা। রাস্তায় লোক নেমে পড়েছে। কিন্তু অস্ত্রের সংখ্যা অতি নগণ্য। একনলা, দোনলা বন্দুক এবং টু-টু রোব রাইফেলসহ মাত্র আটাশটি। শুধু আজাদ গেস্ট হাউসের ছাদে দারোগা নিজামউদ্দীন এবং তার সঙ্গীর কাছে পাঁচটি ৩০৩ রাইফেল। যে দুরন্ত সাতাশটি ছেলে আমার সঙ্গে ২৬শে মার্চের ভোরে অকুতোভয়ে হানাদার বর্বর পাক বাহিনীকে রুখে দাঁড়িয়েছিলো; তাদের সকলের ভাল নাম হলো; (১) এনামুল হক তপন (২) আব্দুল জলিল (৩) এমদাদুল হক তরুন (৪) নূরুল আনোয়ার বাদশা; (৫) শহীদ টিটু; (৬) শহীদ টিটলু; (৭) শহীদ মোস্তাফিজ (ছনু);(৮) শহীদ আজাদ; (৯) শহীদ তারেক (১০) শহীদ খোকন পাইকাড়; (১১) সালাম (স্বাধীনতার পরে আততায়ীর হাতে নিহত); (১২) বখতিয়ার হোসেন বখতু (আর্ট কলেজের ছাত্র); (১৩) খাজা সামিয়াল (১৪) মমতাজ (বর্তমানে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক); (১৫) রাজিউল্লা (১৬) টি এম মূসা (পেস্তা) (১৭) নান্না (১৮) সৈয়দ সোহরাব; (১৯) শহীদ বকুল (২০) বুবলা (২১) জাকারিয়া তালুকদার (২২) মাহতাব (২৩) টাটরু (২৪) বুলু (২৫) বেলাল (২৬) এ কে এম রেজাউল হক (রাজু); (২৭) ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ।

 কালীতলা থেকে রেল লাইনের দু'নম্বর ঘুমটি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে দেয়ালের আড়ালে ছোট ছোট দলে ভাগ করে এদের দাঁড়াবার নির্দেশ দিলাম। কিন্তু এই নির্দেশ ভেঙ্গে টিটু, হিটলু এবং মুস্তাফিজ বড়গোলায় ইউনাইটেড ব্যাংক (বর্তমানে জনতা ব্যাংক)-এর ছাদে ঘাঁটি গেড়ে প্রতিরোধ করে এবং সেখানেই তারা শহীদ হন। তপন, সামিয়াল এবং বখতু ও জলিলসহ চারজনের একটি দল কলীতলার মুখে প্রথম প্রতিরোধের জন্য ঘাটি গাড়লো। প্রত্যেককে নির্দেশ দিলাম গুলী করার সঙ্গে সঙ্গে স্থান ত্যাগ করে এক আড়াল থেকে সরে যেতে হবে অন্য আড়ালে। যুদ্ধ চলাকালীন যোগাযোগ রক্ষা; সংবাদ আদান-প্রদান এবং নির্দেশ পৌছানোর দায়িত্ব নিলো একরামুল হক স্বপন, মঞ্জু (শহীদ আজাদের ভাই), ছাত্র লীগের সামাদ, বিলু (মরহুম আকরব হোসেন আকন্দ সাহেবের ছেলে), সৈয়দ কেরামত আলী গোরা (পরবর্তী কালে পাক সেনাদের হাতে নিহত হন) এবং আবু সুফিয়ান (পরবর্তিকালে পাক সেনাদের হাতে শাহাদাত বরন করেন) সত্যি বলতে কি আমার নিজেকে একজন সেনাপতি সেনাপতি মনে হচ্ছিলো। আমার সেই নির্বোধ সেনাপতির ভূমিকার কথা মনে হলে এখন হাসি পায়।

 ২৬শে মার্চের সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ পাক সেনা সুবিল পার হয়ে বগুড়া শহরে ঢুকলো। সুবিল পার হবার আগে মাটিডালি; বৃন্দাবনপাড়া এবং ফুলবাড়ী গ্রামের কিছু কিছু বাড়ী তারা আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিলো। শহরে ঢুকবার পর পাক সেনাদল রাস্তার দু'পাশ দিয়ে দুটো লাইনে এগুতে শুরু করে। সুবিল (করতোয়ার একটি খাল) পার হবার পর কোন প্রতিরোধ না পেয়ে বেশ নিশ্চিন্তেই তারা এগুচ্ছিলো। রাস্তা জনশূন্য; কোন বাধা নেই। কিন্তু কালীতলাহাট পার হবার পরপরই দেয়ালের আড়াল থেকে তপনের হাতের বন্দুক আচমকা আগুন ঝরালো। অব্যর্থ নিশানা। লুটিয়ে পড়লো একজন পাকসৈন্য। তপনই বগুড়ার প্রথম মুক্তিযোদ্ধা যার অস্ত্র বগুড়ার মাটিতে প্রথম পাক সেনার রক্ত ঝরালো। গুলি করেই তপন এবং তার সঙ্গীরা স্থান ত্যাগ করে আর এক