পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৪৩

 ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় বাদুড়তলার একটি বাড়ীতে যুদ্ধ পরামর্শ সভা বসলো। আলোচনা শেষে জনাব মোখলেসুর রহমানের প্রস্তাবক্রমে পাঁচ সদস্যের একটি হাই কমাণ্ড করা হলোঃ

 (১) গাজীউল হক (অদলীয়); সর্বাধিনায়ক; (যুদ্ধের দায়িত্ব)

 (২) ডাঃ জাহিদুর রহমান (আওয়ামী লীগ) (খাদ্য এবং চিকিৎসার দায়িত্ব)

 (৩) জনাব মাহমুদ হাসান খান (আওয়ামী লীগ) প্রশাসন

 (৪) জনাব মোখলেসুর রহমান (মোজাফফর ন্যাপ); যোগাযোগ

 (৫) জনাব আব্দুল লতিফ (কম্যুনিস্ট পার্টি) প্রচার। ২৬শে মার্চ রাতেই আমরা সুবিলের দক্ষিণ পাড়ে ঘাটি স্থাপন করলাম।

 ২৭শে মার্চ সকাল আটটা। সুবিলের উত্তর পাড় থেকে পাকসেনারা গুলীবর্ষণ শুরু করে। পাল্টা জবাব দেয় আমাদের ছেলেরা। এই দিন ঝণ্টু; মাহমুদ; ডঃ টি; আহমদের ছেলে মাসুদ; গোলাম রসুল; বিহারীর ছেলে (নামটি মনে নেই); রশীদ খানের ছেলে গুলার; রেডিও; রফিকুল ইসলাম লাল; শহীদ আবু সুফিয়ান রানা এবং আরো অনেকে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে ডঃ জাহিদুর রহমান পুলিশ লাইন থেকে বাহিনীর ৬০ জনের এক দলকে নিয়ে এলেন। ৩০৩ রাইফেল হাতে আমাদের ছেলেদের পাশাপাশি তারাও অবস্থান নিলেন। দুই পক্ষে প্রচণ্ড গোলাবৃষ্টি হলো। গোলাবৃষ্টির মধ্যেই হানাদার বাহিনী সড়ক ধরে এগিয়ে এসে শহরের উত্তর প্রান্তে কটন মিল দখল করলো। (তখন বগুড়া শহরের উত্তর সীমার প্রান্তে ছিল কটন মিল)। পুলিশ এবং আমাদের ছেলেদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে শহরের ভিতরে বেশী এগিয়ে আসতে পারলো না হানাদার। এদিনের যুদ্ধে পাকসেনারা ভারী মেশীনগান ব্যবহার করে এবং মর্টারের গোলাবর্ষন করে। বিকেল তিনটার মর্টারের গোলার আঘাতে শহীদ হলো তারেক; দশম শ্রেণীর ছাত্র। মৃত্যুর সময়েও তার হাতে ধরা ছিলো একটি একনলা বন্দুক। তারেকের রক্তে ভিজে গিয়েছিলো আমার বুক। মনে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধড়ে অঝোরে কেঁদেছিলাম।

 ২৭শে মার্চ বিকেলে বাদুড়তলায় একটি খাদ্য ক্যাম্প বসানো হলো এবং তার সঙ্গে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রও খোলা হলো। খাদ্য ক্যাম্পের দায়িত্ব নিলেন মিউনিসিপ্যাল কমিশনার জনাব আমজাদ হোসেন এবং তাঁকে সাহায্য করার জন্য মোশারফ হোসেন মণ্ডল; বাদুড়তলার আবু মিয়া, আবেদ আলী; মজিবর রহমান এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করা খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতেন। প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শহীদ ডাঃ কছিরউদ্দীন তালুকদার সাহেব। তিনি এক সময়ে বগুড়া জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। ঐ সময়ে বৃদ্ধ বয়সে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে যেভাবে তিনি এগিয়ে আসেন একজন চিকিৎসক হিসাবে তা বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরনযোগ্য। তাঁর বাড়িটিও আমাদের শেলটার হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পাক সেনা বাহিনীর হাতে তিনি শাহাদৎ বরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে বগুড়ায় প্রয়াত প্রবীণতম মুসলিম লীগ নেতা ডাঃ হাবিবুর রহমানও সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসেন। ২৭শে মার্চ রাতে খবর পলাম একজন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করছেন।

 ২৮শে মার্চের সকাল। কটন মিলের গেস্ট হাউসের ছাদে পাকসেনারা মেশিনগান বসিয়েছে। তখনো গোলাগুলি শুরু হয়নি। মেশিনগানের পাশে দু জন পাকসেনা দাঁড়িয়ে। একজন পাকসেনা ছাদের রেলিং এ ভর দিয়ে কি যেন দেখছে। দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে দুরন্ত ছেলে তপন রাইফেল তুললো। অব্যর্থ লক্ষ্য। ছাদের ওপর থেকে পাকসেনাটি ছিটকে পড়লো মাটিতে। পিছু হটে তপন লাফিয়ে পড়লো রাস্তার পাশের নর্দমায়। নর্দমার দেয়াল ঘেষে সরে এলো আড়ালে।