পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৪৬

করলো। শহীদ হলো নির্ভীক সেনা, বগুড়ার এক বীর সেনানী। যুদ্ধে জয় হলো। পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। বন্দী সেনাদের এবং আটান্ন ট্রাক ভর্তি এম্যুনিশন নিয়ে ফিরলাম। কিন্তু চোখের জল বাধা মানছিলে না। মাসুদকে হারিয়ে এলাম চিরদিনের জন্যে। সেদিনই ঘোষণা করেছিলাম আড়িয়ার নাম হবে ‘মাসুদনগর’। রাতে ২১ টি গান স্যালুটের মাঝে মাসুদকে কবরে সমাহিত করলাম। দেখলাম ডাক্তার জাহিদুর রহমানের দু'চোখেও জলের ধারা নেমে এসেছে।

 আড়িয়ার ক্যাণ্টনমেণ্ট একজন পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন (ক্যাপ্টেন নূর) সহ ৬৮ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। এরমধ্যে ছিল ২১ জন পাঞ্জাবী সৈন্য। জনতার ক্রুদ্ধ আক্রমণের হাত থেকে এদের রক্ষা করতে পারিনি। জেলখানার তালা ভেঙ্গে ওদের বের করে নিয়ে এসে কুড়ুল এবং বঁটি দিয়ে কুপিয়ে আমার অনুপস্থিতিতে ওদের হত্যা করে। বাঙ্গালী সৈন্য যারা ছিলো তাদের নজরবন্দী করে রাখা হলো। আড়িয়া ক্যাণ্টনমেণ্ট কিছু চাইনীজ রাইফেল ও গুলী পাওয়া যায়। ৫৮ ট্রাক ভর্তি এম্যুনিশন পাই, কিন্তু তা ব্যবহারের অস্ত্র ছিলো না। অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বললেন, সেগুলো ছিলো ১০৫ গান এবং আর-আর-এর এম্যুনিশন।

 ২রা এপ্রিল। পাবনার এস-পি জনাব সাঈদ এলেন এবং কিছু রাইফেলের গুলি নিয়ে যান। তাঁকে বললাম যেমন করে হোক ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী সাহেবকে বগুড়া নিয়ে আসতে।

 ৩রা এপ্রিল। জনাব কামরুজ্জামান, শেখ মনি এবং তোফায়েল আহমদ বগুড়া এসে উপস্থিত হলেন। ডাঃ মফিজ চৌধুরীকে সঙ্গে দিয়ে তাদের সীমান্ত পার করে দেরাব ব্যবস্থা করলাম। জনাব শেখ মনির কাছেই জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু পাক সেনাদের হাতে বন্দী।

 ৪ঠা এপ্রিল। বগুড়া আওয়ামী লীগের জনাব আব্দুর রহিম তালুকদার জীপ নিয়ে ক্যাপ্টেন মনুসর আলীকে নিয়ে বগুড়া পৌঁছালেন। তার সঙ্গে জনাব আবু সাঈদ এম-পি। মনসুর ভাইকে বিশেষ করে অনুরোধ করলাম যাতে প্রোভিশানাল গভর্নমেণ্ট-এর নাম ঘোষনা করেন। মনে আছে একটা সিগারেটের প্যাকেটের সাদা অংশে বি-এস-এফ-এর কর্নেল মুখার্জীকে লিখেছিলাম মনসুর ভাইকে নিরাপদে তাজউদ্দীনের কাছে পাঠানোর জন্যে।

 ৫ই এপ্রিল। মেজর নজমুল হক বগুড়া এলেন। জেলা প্রশাসক জনাব খানে আলমের কুঠিতে আলোচনা সভা বসলো। মেজর নজমুল হক জানালেন যেমন করে হোক ১০৫ কামান এবং আর-আর জোগাড় করতে হবে। তিনি বললেন হিলিতে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার চাটার্জীর সঙ্গে দেখা করতে। তার সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হলো, যদি কোন প্রকারে আমরা রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করে উত্তরাঞ্চল শত্রুমুক্ত করতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমন ঠেকাতে পারবো।

 ৬ই এপ্রিল। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি এবং জাহিদুর রহমান হিলি যাই। পশ্চিম হিলিতে গেলে আমাদের দু'জনকে এক প্রকার নজরবন্দী করে রাখে সারাদিন। সন্ধ্যায় জানালো রাত তিনটায় ব্রিগেডিয়ার চাটার্জী আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। রাত তিনটায় ব্রিগেডিয়ার চাটার্জী সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাদের দু'পেটি ৩০৩ রাইফেলের গুলী দিয়ে বিদেয় দিলেন এবং ১৬ই এপ্রিল হিলিতে তার সঙ্গে আবার দেখা করতে বললেন। জানালেন তিনি ভারত গভর্নমেণ্টকে আমাদের অবস্থা জানিয়ে অস্ত্র সাহায্য করতে অনুরোধ জানাবেন।

 ৭ই এপ্রিল। প্রায় খালি হাতেই বিকেল বেলা আমি এবং ডাঃ জাহিদুর রহমান হিলি থেকে ফিরলাম। মুক্তিসেনারা সাগ্রহে আমাদের প্রতীক্ষা করছিলো। কিন্তু আপাতত কোন সামরিক সাহায্য না পাওয়ার কিছুটা হতোদ্যম হলো বলতে হলো। বলতে ভুলে গেছি, ২রা এপ্রিল থেকেই মুক্তি সেনাদের কয়েকটি ক্যাম্পে ভাগ করে দিয়ে সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং- এর ব্যবস্থা করেছিলাম। করোনেশন স্কুলে একটি ক্যাম্প, সেণ্ট্রাল হাই মাদ্রাসার একটি ক্যাম্প এবং জিলা আনসার অফিসের মাঠে একটি ক্যাম্প। ইপিআর বাহিনীর ব্যবস্থা করেছিলাম এডওয়ার্ড পার্কের কম্যুনিটি সেণ্টার হলের একে তলায়। কণ্ট্রোল রুম শিফট করেছিলাম দোতলায়। বগুড়া সার্কিট হাউসে প্রশাসন