পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৪৯

 ২৭শে মার্চ তারিখে পাবনা শহরের বুকে এ লড়াই শুরু হয়েছিল। ২৭শে থেকে ২৯শে, এই তিন দিন ধরে লড়াই চলল ২৬শে আর ২৭শে এই দুইদিন ওরা শহরর উপর কারফিউ জারী করেছিল। তা সত্বেও ঐ অবস্থাতেই শহরের যুবক ও ছাত্ররা ২৬শে মার্চ সারাদিন আর সারারাত প্রতিরোধের জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। ঐ একটি দিনের মধ্যে তারা বেশ কিছু অস্ত্র হাত করে নিয়েছিল। সেই একটি দিনে কারফিউ আইন ভঙ্গকারীদের মধ্যে ৮/১০ জন সৈন্যদের গুলিতে মারা গিয়েছে, কিন্তু প্রতিরোধকারীদের মনোবল তাতে একটুও ভঙ্গে পড়েনি।

 পাবনা শহরের প্রতিরোধের ব্যাপারে ডি,সি-র প্রথম থেকেই সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আওয়ামী লীগের নেতা আমজাদ সাহেব আর তিনি মিলিটারীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলবার জন্য ভেতরে ভেতরে চেষ্টা করে চলেছিলেন। তাঁরা দুইজন চর-অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং প্রতিরোধের ব্যাপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলেছেন। মানুষ ভেতরে ভেতরে তৈরি হয়েই ছিল। তাঁদের এই আহবানে উৎসাহিত হয়ে দলে দলে কৃষক এই হামলাকারী শত্রুদের খতম করে দেবার জন্য শহরের দিকে ছুটে আসতে লাগল।

 ২৮শে মার্চ। ২৭ জন সৈন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করে নিয়ে পাহারা দিয়ে চলেছিল। চরের কৃষকরা ছুটতে ছুটতে এসে তাদের ঘেরাও করে ফেলল। তাদের হতে লাঠিসোটা, বর্ণা -বল্লম ধনুক, তীর- ধনুক আরও কত রকমের হাতিয়ার। ব্যারাক থেকে সকল পুলিশ চলে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তাছাড়া শহরের যুবক ও ছাত্ররা দলে দলে ছুটে এসে তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াল। শেষ পর্যন্ত জনতা প্রায় ১৫ হাজারে এসে দাঁড়াল। তাদের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে সারা শহর কেঁপে উঠল, থরথরিয়ে কেঁপে উঠল অবরুদ্ধ পাক সৈন্যদের মন। এবার দু'পক্ষে গুলিবর্ষণ চলল। সৈন্যদের হাতে মেশিনগান ও উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্র। পুলিশরা শুধু রাইফেল নিয়েই লড়ছিল। জনতার মধ্যে যাদের হাতে বন্দুক ছিল, তারাও সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। সৈন্যরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সুরক্ষিত আশ্রয়ে থেকে আড়ালে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছিল। কাজেই সংখ্যায় কম হলেও তাদের খতম করে ফেলা সহজ কাজ ছিল না-ওদের মেশিনগানের অবিরল গুলিবর্ষণকে ভেদ করে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতই দুঃসাহসের কাজ। সেই কারণেই অনেকক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। হাজার হাজার জনতা এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে কোন কার্যকর সাহায্য করতে না পারলেও তাদের আকাশ-ফাটানো জয়ধ্বনি পাক-সৈন্যদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে তুলেছিল। তারা হতবুদ্ধির মত হয়ে গিয়েছিল। তাই উন্নততর অস্ত্রশস্ত্র হাতে থাকলেও তারা তাদের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেনি। এমনিভাবে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে এক এক করে তাদের ২৭ জনই মারা গেল। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্র মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেল।

 জয়োল্লাসে মেতে উঠল সারা শহরের মানুষ। বুড়ো থেকে বাচ্চারা পর্যন্ত আনন্দধ্বনি করতে করতে ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছিল। যে সমস্ত সৈন্য ট্রেজারী ও শহরের অন্যান্য জায়গায় মোতায়েন ছিল মুক্তিবাহিনীর প্রতি-আক্রমণের সূচনাতেই তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নিহত হয়েছে, বাকী সবাই পালিয়ে গিয়েছে। সারা শহরের পথে পথে জনতার বিজয় মিছিল চলছে।

 শহর থেকে শত্রুসৈন্যরা নিহত ও বিতাড়িত হলেও শহর বিপদমুক্ত নয়। শহর থেকে মাইল চারেক দূরেই ইপসিক-এর অফিস বাড়িতে শত্রুসেনারা মূল বাহিনীর অধিকাংশ ঘাটি করে বসে আছে। তাদের সংখ্যা দেড়শতের মত। সংখ্যার দিক দিয়ে যাই হোক না কেন অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী। শহরকে বাঁচাতে হলে তাদের রাহুগ্রাস থেকে শহরকে মুক্ত করতে হবে। একট কথা মনে রাখতে হবে, যে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে যারা উজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করে আসছে, পাবনা জেলায় সেই ইপিআর বাহিনীর কোন অস্তিত্ব ছিল না। পুলিশ ভাইয়েরাই এখানকার একমাত্র সশস্ত্র যোদ্ধা কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে তারা খুবই দুর্বল। হামলাকারী পাক সৈন্যদের মূল ঘাঁটি থেকে হটিয়ে দেয়া তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। এক্ষেত্রেও জনতাই সামনে এগিয়ে এল।