পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৫০

 পাবনা শহরের লড়াইয়ের খবরটা শহরের বাইরে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বাইরে গ্রামাঞ্চল থেকে বিভিন্ন কৃষক সমিতির লোকেরা শহরকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করবার জন্য সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে আসছিল। তারা দলে দলে এসে শত্রুপক্ষের মূল ঘাঁটিকে ঘেরাও করে ফেলল। রাত্রির অন্ধকারে ঘটনাটা এমন দ্রুতভাবে ঘটে গিয়েছিল যে, ওরা কৃষক- জনতার এই অবরোধ থেকে বেরিয়ে পড়বার মত সময় বা সুযোগ পায়নি। পুলিশ ভাইয়েরাও এ আক্রমণে কৃষকদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছিল। তারা শত্রুপক্ষের মেশিনগানের পাল্লার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ দিয়ে চলেছিল।

 অবরোধকারীদের প্ল্যান ছিল এই যে, তারা এইভাবে দিনের পর দিন বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দিয়ে ওদের না খাইয়ে মারবে। কৃষক জনতার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রায় কুড়ি হাজারে এসে দাঁড়াল। মুক্তিবাহিনীর এই বিরাট সমাবেশের দিকে তাকিয়ে এবং তাদের উম্মাত্ত গর্জন শুনে অবরুদ্ধ পাক সৈন্যরা এগিয়ে এসে আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছিল না। দু'পক্ষ পরস্পরের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রক্ষা করে গুলি বিনিময় করে চলেছিল।

 সময়ের সাথে সাথে অবরোধকারীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে পাক সৈন্যরা এটা নিশ্চতভাবে বুঝে নিয়েছিল যে এই সুদৃঢ় প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই তারা বেতারযোগে ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে সমস্ত অবস্থাটা খুলে জানাল। জানাল। জানার যে, তাদের জীবন বিপন্ন, অবিলম্বে সাহায্য দরকার।

 খবর পাঠাবার কিছুকাল বাদেই আকাশে জেট বিমানের ঘোর গর্জন শোনা গেল। শব্দ শুনে চমকে উঠে সবাই উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেই বিমান সমস্ত অঞ্চলটা প্রদক্ষিণ করে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। একটু বাদেই প্রচণ্ড বিস্ফোরন শব্দ। সেই হিংস্র যন্ত্র-দানবটা জনতার ভীর লক্ষ্য করে একর পর এক বোমা ফেলে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ার্ত চীৎকার আর ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। শুধু বোমা ফেলা নয়, প্লেনটা মাঝে মাঝে বাজপাখির মত ছোঁ মেরে নীচে নেমে আসছে, আর এক এক পশলা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে চলে যাচ্ছে। বোমারু বিমানের এই অতর্কিত আক্রমণে কিছুসংখ্যাক লোক হতাহত হোল, জনত ইতস্তত ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে লাগল। অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যরা এই সুযোগে অবরোধের বেড়া ভেঙে ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রান নিয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু তাদের সঙ্গী সবাই পালিয়ে যেতে পারেনি। অবরোধ ভেঙে গেলেও মুক্তিবাহিনীর একদল সশস্ত্র যোদ্ধা তখনও তাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। কিছুসংখ্যাক সৈন্যকে হতাহত অবস্থায় রণক্ষেত্রে ফেলে রেখে অবশিষ্ট পাক বাহিনী এই মৃত্যুর ফাঁদ থেকে পালিয়ে বাঁচল।

 এইভাবে শত্রুসৈন্যদের বিতাড়িত করে জয়োন্মত্ত কৃষক-জনতা উল্লাসধ্বনি করতে ফিরে এল। মুক্ত নগরী পাবনা উৎসবমুখর হয়ে উঠল। কিন্তু পরদিন এই উৎসবের আনন্দ-কোলাহলের মধ্যে বিষাদের এক কালো ছায়া নেমে এল। এই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ সাহেব ২৯শে মার্চ তারিখে হঠাৎ করোনারী থ্রম্বসিস রোগে মারা গেলেন। এ সম্বন্ধে কোনই সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধাবস্থায় কঠিন পরিশ্রম ও দারুন উত্তেজনাই তাঁর এই অকালমৃত্যুকে ডেকে এনেছিল। একথা বললে ভুল হবে না যে, পাবনা শহরের মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা প্রাণ দিয়ে শহীদ হয়ে গেছেন, আমজাদ সাহেব তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

 কিন্তু এই মুক্তিযুদ্ধের এইখানেই ইতি নয়। বিতাড়িত পাক-সৈন্যরা তাদের ইপসিকের ঘাঁটি ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালল বটে, কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। উদভ্রান্ত ও দিশেহারা পলাতক সৈন্যদের পালাবার পথে পর পর দু'বার -প্রথম দাশুরিয়া পরে মুলাডুলিতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। এই দুই জায়গাতেই প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটেছিল। দুই সংঘর্ষের ফলে অবশিষ্ট পাকবাহিনীর প্রায় সবাইকেই প্রাণ দিতে হলো, কেবলমাত্র চারজন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল।