পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



৩৫৩

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

 শেষ সময় আমরা ১০০ কজন ছিলাম ঘটনাতে। এসডিও শামসুদ্দিন সাহেব নিজে কমাণ্ডিং অফিসার। ৪/৫ দিন আমরা না খেয়ে।

 সিদ্ধান্ত হয়, এসডিও সাহেব ৪০ জন ছেলে নিয়ে অস্ত্রসহ সিরাজগঞ্জ যাবেন সিরাজগঞ্জ রক্ষার জন্য। এখানে ২০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমরা ৫০/৬০ জন থাকবো ঘাটনাতে। পাক বাহিনীকে বাধা দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ এসে শেষযুদ্ধ হবে। সেই মত এসডিও সাহেব চলে যান। আমি, লতিফ মীর্জা, রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদেও সাধারণ সম্পাদক সামাদ থাকলো ঘাটনাতে। আমি এবং লতিফ মীর্জা ১০ জনের খাবার যোগাড় করে ঘাটনা ব্রজে রওনা হই। কারণ ওখানে সামাদের নেতৃত্বে ১০ জন যোদ্ধা ছিল পাহারায়। আমরা খাবার পৌছলে দেখতে পেলাম একটি ট্রেন আসছে ঈশ্বরদী থেকে। আমাদের খাওয়া হলো না। খাবার পাঠিয়ে দিয়ে আমরা ১২ জন দু’দিকে ডিফেন্স নিই। আমাদের ২টি এলএমজি এবং ১০টি চাইনিজ রাইফেল ছিল। ট্রেন ব্রিজের কাছে আসলে দেখলাম গাড়ীটি পাকসেনাতে ভর্তি। ওর মইন সরাচ্ছে আর অগ্ররস হচ্ছে। পাক-সেনারা নেমে এখানে-ওখানে ঘোরাফিরা করছে। মিস্ত্রীরা লাইন সারছে। ক্রমশ ৪০/৫০ জন পাকসেনা ব্রিজের এক স্থানে একত্রিত হতে থাকে। পাকসেনাদের সাথে বেসামরিক পোশাকে অনেক বিহারীকে দেখলাম। ৪০/৫০ জন একস্থানে হলে আমি ফায়ার ওপেন করতে বলি; সাতে সাথে ১০টি চাইনিজ রাইফেল ও ২টি এলএমজি গর্জে ওঠে। ক্রস ফায়ারের সাথে সাথে সবকটি সৈনিক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাকিরা সব ট্রেনে উঠে ট্রেনটি পিছনে নিয়ে গিয়ে অনবরত মেশিনগান এবং মর্টার দিয়ে বৃষ্টির মত গোলা ছুড়তে থাকে। ৩ ঘণ্টা গুলি ছোড়ার পর আমরা জঙ্গল থেকে বের হই। আমরা ক্লোজ রেঞ্জে থাকায় আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু ১ মাইল দূরে যে আমাদের ক্যাম্প ছিল সেখানে গোলা পড়ায় আমাদের ছেলেরা সব পালিয়ে যায়-মনে করে আমরা সব মারা গেছি। রাতে কিছুদূর এসে দেখলাম যে বাইনোকুলার ফেলে এসেছি। ১০ জনকে রেখে আমি এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের মহিউদ্দীনকে নিয়ে ঘটনা ব্রিজে যাই বাইনোকুলার খুঁজতে। সেখানে পৌছে দেখলাম একটি নৌকা করে কিছু পাকসেনা পার হচ্ছে। কৌতুহল বশে বাইনোকুলার খোঁজা বাদ দিয় পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কি হয় দেখার জন্য। দেখলাম ৪ জন পারে নামলো। অকস্মাৎ অন্ধকারে তারা হারিয়ে যায়। আমরা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর পাতার মচমচ শব্দ শুনতে পেলাম এবং ছায়ার মত আমাদের দিকে আসছে দেখলাম। আমাদের হাতের দুটি চইনিজ এসএমজি একসাথে গর্জে ওঠে। পতনের শব্দ পেলাম। পাল্টা কোন গুলি হয় না, বুঝলাম সব খতম। তার পরপরই নদীর অপর পার থেকে ঝাঁক ঝাঁক গুলি আসতে লাগলো। আধ ঘণ্টা পর গুলি বন্ধ হলে ক্রলিং করে পালিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে এসে আর সব সার্থীদের সাথে মিলিত হই। ক্যাম্পে এসে শুনি আমাদের ছেলেরা সব পালিয়েছে। লোকজন অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে, জিনিসপত্র লুট করেছে। নাম সংগ্রহ করে চারজনকে ধরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পাক বাহিনী ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালায়-দু ঘণ্টা ধরে বৃষ্টির মত মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে গুলি চালায়। গুলি বন্ধ হলে আমরা পালিয়ে সিরাজগঞ্জের দিকে রওনা হই।

হজাদপুরসহ অন্যান্য স্থানের সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকারঃ আবদুর রহমান, প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য
১২-১১-১৯৭৩

 ২৫মে মার্চ দিনগত রাত দুটোর সময় শাহজাদপুর থানার ওসি আমার কাছে একজন পুলিশ পাঠিয়ে সংবাদ দেন যে, “ঢাকায় সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহ হয়েছে এবং ইয়াহিয়া কানকে বন্দী করে রাওয়ালপিণ্ডি পাঠিয়েছে। আপনি অবিলম্বে থানায় এসে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে কর্তব্য নির্ধারণ করুন।” আমি ভেবে দেখলাম এ সংগ্রামের কেবল শুরু-অনেকদিন চলবে। কাজেই উত্তেজিত না হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। থানায় গিয়ে দেখি


  • বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত