পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৫৫

পার হয়ে নগরবাড়ী-পাবনার পাকা রাস্তায় উঠতে পারে। আমরা সেজন্য ঐ সমস্ত জনসাধারণকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে আসি।

 ৯ই এপ্রিল বেলা ৪টার দিকে পাক-বাহিনী বিমান আক্রমণ করে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।কয়েকজন আহত হয়। বিমান আক্রমণের কথা আমরা এতটা ভাবি নাই। সতর্কতার কোন উপায়ও ছিল না। কারণ, পাবনা গিয়ে আমি ও ক্যাপ্টেন হুদা মেশিনগান নিয়ে আসি। পরে দেখা গেল তার পিন ভাঙ্গা। এর দুই দিন আগে ঈশ্বরদী থেকে একটা হাত-সাইরেন আনা হয়েছিল। সন্ধ্যার পর দেখা গেল তার এমন একটা পার্টস কেউ ভেঙ্গে রেখেছে যে বাজানো যায় না।

 ক্যাপ্টেন হুদা বারে বারেই অস্ত্রের কথা বলছিলেন, কিন্তু পাবনা ও বগুড়া ছাড়া কোথাও আমার চেষ্টা করার জায়গা ছিল না। তৎকালীন ডি-সি জনাব নুরুল কাদের খানের মাধ্যমে চেষ্টা করে কুষ্টিয়া থেকে কিছু আনসার আনা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিনের বিমান আক্রমণের পরই তারা চলে যায়।

 পরদিন ১০ই এপ্রিল সকালে আবার বিমান আক্রমণ হয়। ঐদিন আমাদের কেহ হতাহত হয়নি। কয়েকজন গ্রামের লোক মারা গিয়েছিল কিন্তু আমাদের সমস্ত বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে যায়।

 বাঘাবাড়ী প্রতিরোধঃ শাহজাদপুর এসে আমি বাঘাবাড়ীতে প্রতিরক্ষা গড়ার চেষ্টা নেই। এই সময় সিরাজগঞ্জে তৎকালীন এস-ডি-ও জনাব জনাব শামসুদ্দিন আসেন এবং যুদ্ধের প্রদান কাজকর্ম তিনি উপস্থিত থেকে করান। তিনি অবশ্য পরে শাহজাদপুরে ছিলেন না, মাঝে মাঝে আসতেন।

 নগরবাড়ী থেকে আসার পর আমি বগুড়ার সাথে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে বেশ কিছুসংখ্যক ইপিআর আসে। তাদের নিয়ে প্রথমে বেড়া যাই। পরবর্তী সময়ে জনাব শামসুদ্দিনের সঙ্গে পরামর্শ করে একদিন রাতে আমরা নগরবাড়ীতে অবস্থানরত পাক বাহিনীকে আক্রমণ করার প্রোগ্রাম করি। কিন্তু অনেকের, বিশেষ করে ট্রাক ড্রাইভারের অসহযোগিতার জন্য ঐ আক্রমণ সফল হয় নাই। আমরা নিজেরা প্রায় দুই ঘণ্ট ধাক্কিয়েও ট্রাক সচল করতে পারি না। অতঃপর ভীষণ বৃষ্টি ও বাতাসে খেজুরপাতার পার্টিতে খোলা ঘরে মাটিতে শুয়ে থেকে ঠাণ্ডায় যখন হাত-পা হিম হয়ে এসেছিল তখন আমরা কোনক্রমে রাত ৪টায় বেড়া সিএণ্ডবি ডাকবাংলোয় চলে আসি। ঘণ্টাখানেক পর সমস্ত বাহিনীও বৃষ্টিতে ভিজে ফিরে আসে। আরও কয়েকটি আক্রমণের চেষ্টা আমরা করলেও নানা ত্রুটির জন্য তা সফল হয় নাই।

 অবশেষে ১৯শে এপ্রিল পাক বাহিনীই বেড়ার ডাব-বাগানে অবস্থানরত আমাদের বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। উভয় পক্ষেই প্রচুর ক্ষতি হয়। পরের দিনই বাঘাবাড়ীতে অবস্থানরত আমাদের সংগৃহীত ও সিরাজগঞ্জের সশস্ত্র বাহিনী ঐ স্থান ত্যাগ করে। তার পরদিন আমার কাছে খবর আসে যে, ডাব-বাগানে আমার পক্ষে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের কবরও দেওয়া হয় নাই। আমি দুজন কর্মী নিয়ে অমনি রওনা দিই। কিন্তু বেড়া পৌঁছার পর ঐ স্থানের কর্মীরা আর আমাদের অগ্রসর হতে দেয় নাই।

 ২২শে এপ্রিল পাক বাহিনী বাঘাবাড়ীতে এসে শাহজাদপুরকে লক্ষ্য করে শেল মারতে থাকে এবং বাঘাবাড়ী ও শাহজাদপুরের পতন হয়।

মুক্তিপাগল এক সরকারী অফিসার[১]

 তিনি শুধু একজন মহকুমা প্রশাসক বা সিএসপি অফিসারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন অগ্রসেনা, এক নির্ভীক যোদ্ধা। মুক্তি সংগ্রাম শুরুর সেই প্রথম ক্ষণেই সিরাজগঞ্জে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার নেতৃত্ব দিয়েছেলেন মুক্তিপাগল এই বীর সেনানী। শুধু সিরাজগঞ্জেই নয়, সারা উত্তরবঙ্গই উত্তাল হয়ে


  1. দৈনিক বাংলা, ১৫ জানুয়ারী ১৯৭২-এ মনজুর আহমদ প্রদত্ত প্রতিবেদন।