পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৫৮

আনা হয়। বেসামরিক শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ও একটি পরিষদ গঠন করা হয়। ডেপুটি কমিশনার, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও অন্যদের নিয়ে এ কমিটি গঠিত হয়েছিল। এছাড়া বরিশাল শহরের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হয়। এগুলি ছিল বেলস পার্ক, সদর গার্লস হাইস্কুল, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী (কমাণ্ডো ট্রেনিং-এর জন্য), মাধবপাশা ও প্রতাপপুর। অন্যান্য থানাগুলিতেও এরূপ অনেক ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হয়। এসব কেন্দ্রে হাজার হাজার যুবক দেশকে মুক্ত করার জন্য ট্রেনিং নিতে শুরু করে। বেলস পার্কে সর্ববৃহৎ ট্রেনিং কেন্দ্র ছিল। এখানে হাজার হাজার যুবক ট্রেনিং নিতে থাকে এবং এদের অনেককে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়। আমি সমস্ত ট্রেনিং কেন্দ্রের উপর নজর রাখতাম। ক্যাপ্টেন হুদা মেজর জলিলের সাথে থাকতেন এবং অন্যান্য দিকগুলির উপর নজর রাখতেন।

 অয়ারলেসের মাধ্যমে আমরা পূর্বেই চাঁদপুর, পিরোজপুর, বাগেরহাট ইত্যাদি স্থানে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলাম। চাঁদপুর থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী অয়ারলেসের মাধ্যমে খবর পাঠালেন পাকসেনা যে কো মুহুর্তে চাঁদপুর আক্রমণ করতে পারে। তিনি আমাদের কিছু লোক পাঠাতে বললেন। মেজর জলিলের নির্দেশে আমি প্রায় ১০০ জন যুবককে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদসহ চাঁদপুরে পাঠিয়ে দিলাম। ফরিদপুর, পটুয়াখালী বাগেরহাট, খুলনা পিরোজপুর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও আমি প্রায় এক হাজার জনকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে শত্রুর আক্রমণকে রুখবার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। এছাড়াও বিভিন্ন থানা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আরো ৫০০ জনকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ শত্রুদের রুখবার জন্য পাঠিয়ে দিই। ব্রজমোহন কলেজের কেমিস্ট্রির একজন অধ্যাপক এবং বিজ্ঞান বিভাগ ও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় আমরা হ্যাণ্ড গ্রেনেড, মলোটভ ককটেল ইত্যাদি হাতবোমা তৈরী করতে শুরু করে দিলাম এবং এগুলি বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিলাম। বরিশাল-পটুয়াখালী যেহেতুে নদী প্রধান ছিল, সেহেতু শত্রুরা গানবোট নিয়ে আমাদের আক্রমণ করবে এ সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। তাই গানবোট ধ্বংস করার জন্য 'রকেট' ধরনের বোমা তৈরী করার চেষ্টা করি। এতে কিছুটা সফল হলেও আমরা তা কার্যকর করতে পারিনি।

 ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের প্রবল চাপের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে শুরু করেছে। পাকসেনাদের তুলনায় আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল খুবই কম। সেজন্য অন্য কোথাও থেকে অস্ত্র যোগাড় করা যায় কিনা চিন্তা করতে থাকি। বন্ধুদেশ ভারত থেকে অস্ত্র যোগাড় করার জন্য দক্ষিণাঞ্চল কমাণ্ডের প্রধান মেজর জলিল আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জুরকে ভারতে পাঠান। অস্ত্রশস্ত্র যোগার করা ছাড়াও অন্যান্য নেতাদের সাথে যোগাযোগ করাও প্রয়োজন ছিল। আমরা চিন্তা করে দেখলাম পাকিস্তানীদের সাথে এ অবস্থাতে পেরে ওঠা সম্ভব হবে না। তবুও বরিশালের সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্ব ছিল। আমরা বরিশালকে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই। সেজন্য ঢাকা থেকে বরিশাল আসার পথের উপর ২টি সড়কসেতু ধ্বংস করে দিই। ঢাকা থেকে বরিশালের সরাসরি রাস্তাযোগে কোন যোগাযোগ না থাকলে এই সড়কসেতু ২টি উড়িয়ে দেয়াতে শত্রুদের বরিশাল যাবার পথে বাধার সৃষ্টি হয়। ফেরীগুলি নষ্ট করে দেয়া হয়। পাকসেনারা যাতে বিমানে করে নামতে না পারে তার জন্য রহমতপুর এয়ার বেইসে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। কালিজিরা নদীতে শত্রুদের বাধা দেবার জন্য শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। শত্রুরা যাতে নদীপথে আসতে না পারে তার জন্য বরিশাল থেকে ৫/৭ মাইল দূর পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় বাংকার খুঁড়ে নদীপথের উভয় দিকে শত্রুদের অগ্রগতিকে বাধা দেবার জন্য বেশ কয়েকটি অবস্থান গড়ে তুলি।

 অন্যদিকে, খুলনা হয়ে শত্রুরা যাতে বরিশালে ঢুকতে না পারে তার জন্যও ঝালকাঠিতে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করার জন্য আমি সেখানে যাই। খুলনা থেকে বরিশালে নদীপথ আসতে হলে গাবখান চ্যানেল হয়ে আসতে হবে। তাই গাবখানের উভয় পাশে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করি এবং মধ্যে একটি ‘ফ্ল্যাট’ রেখে দিই যাতে শত্রুদের গানবোট না আসতে পারে। শত্ররা নদীপথে পার না হতে পারলে নদীর এক পাড়ে নামবে, তখন আমরা আক্রমণ চালাব। এটা ছিল পরিকল্পনা।