পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৬৬

বরিশাল রণাঙ্গনে[১]

 পাকসৈন্যরা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি মাদারীপুর শহর দখল করে নিয়েছিল। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ওরা মিলিটারী ভ্যান নিয়ে বরিশাল জেলার সীমানায় এসে প্রবেশ করল। খবর পেয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য মুক্তিবাহিনী গৌরনদী থেকে মার্চ করে এগিয়ে চলল। এদের মধ্যে যুদ্ধ-বিদ্যায় অভিজ্ঞ কেউ ছিল না- সকলেই কাঁচা, সকলেই অনভিজ্ঞ। মাস খানেকের রাইফেল ট্রেনিং আর নির্ভীক দেশ প্রেম, এই টুকু কেউ সম্বল করে তারা এই দুর্ধর্ষ শত্রুদের মোকাবিলা করতে চলেছে।

 বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার সীমান্তরেখায় ভুরপাটা গ্রাম। পাক-সৈন্যবাহিনী বেলা এগারোটার সময় এই ভুরপার্টার সেতু পেরিয়ে ইল্লা গ্রামের দিকে চলে এসেছে। দু'পাশের গ্রামবাসীদের মনেও আতঙ্কের সঞ্চার করে ভ্যানগুলি গর্জন করে ছুটে আসছে। রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার সবকিছুই আছে তাদের সঙ্গে। কুড়ি-পঁচিশটা রাইফেল আর বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ-বিদ্যায় অশিক্ষিত একদল তরুণ তাদের প্রতিরোধ করতে চলেছে।

 মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু'টি তরুণ এই সীমান্তে এলাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগঠনের কাজ করে চলেছিলেন। দু'জনেই কলেজের অধ্যাপক। মতৃভূমির স্বাতীতার জন্য অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে দিয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে এসেছেন। আজ সকল কর্তব্যের বড় বর্তব্য মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়া। শত্রুসৈন্যরা যে বরিশাল জেলার মাটির উপর এসে গেছে, এখবরটা তখনও তাঁরা জানতে পানেনি। আক্রমণ আসন্ন, ভুরপাটা গ্রামের সেতুটিকে এখণই ভেঙ্গে ফেলা দরকার। সেতুটাকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য তাঁরা দু'জন রিকশাযোগে ভুরপাটা গ্রামের দিকে চলেছিলেন। ইল্লা গ্রামে এসে পৌঁছতেই মিলিটারী ভ্যানের গর্জন শুনে চমকে উঠলেন তাঁরা। সরে পড়ার সময় ছিল না, কয়েক মুহুর্তের মধ্যে দ্রুতবেগে ছুটে আসা ভ্যানগুলি তাঁদের দৃষ্টিগোচরে এসে গেল। তার ঠিক সেই সময় একটা বুলেট তাঁদের দু'জনের মাঝখান দিয়ে রিকশার গা ভেদ করে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দ'জন রিকশা থেকে পথের দু'পাশে ছিটকে পড়লেন। বরিশাল জেলার বুকে শত্রুপক্ষের এই প্রথম গুলিবর্ষণ।

 তাঁরা দু'জন হামাগুড়ি দিয়ে উঁচু সড়ক থেকে নীচে নেমে এলেন। তাঁদের ভাগ্য ভাল, তাঁরা শত্রুদের নজরে পড়ে যাননি। তাঁরা গুণে গুণে দেখলেন। ১০টা ভ্যন, তার পেছনে একটা এ্যাম্বুলেন্স গাড়ি। ভ্যানগুলি সম্ভবত গৌরনদীকে লক্ষ্যকরে ছুটে চলে গেল। এঁরা দু'জন গ্রামের পথ ধরে পেছন পেছন ছুটলেন।

 বার্থী গ্রামের সামনে গিয়ে ভ্যানদুটি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর একদল সৈন্য ভ্যন থেকে নেমে গ্রামের ভেতর ঘুরে ঘুরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ে চলল। যাকে সামনে পেল তাইে মারল। তখন কালীপূজার সময়। ওরা পূজাবাড়িতে গিয়ে পূজায় রত দু'জন পুরোহিতকে হত্যা করল। এই 'পবিত্র' কর্তব্য সুসম্পন্ন করে ভ্যানগুলি আবার তাদের গন্তব্যস্থলের দিকে যাত্রা করল।

 বার্থী থেকে মাইল দুই দূরে কটকস্থল নামে একটি গ্রাম। মুক্তিবাহিনীর যে যোদ্ধারা শত্রুসৈন্যদের প্রতিরোধ করবার জন্য গৌরনদী থেকে যাত্রা করেছিল, তারা সেই সময় এই কটকস্থল গ্রামে পথের ধারে বসে বিশ্রাম করছিল। ভ্যানগুলি এগিয়ে আসতেই প্রতিদ্বন্দ্বী দু'পক্ষ পরস্পরকে দেখতে পেল। পাক-সৈন্যরা তাদের লক্ষ্য করে প্রথমেই গুলি ছুড়ল। প্রতিপক্ষ যে কোন সময় তাদের উপর এসে চড়াও হতে পারে, এমন একট অবস্থার জন্য মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধারা প্রস্তুত ছিল না। সেজন্য তাদের মূল্যও দিতে হয়েছিল। কিন্তু একটু বাদেই তারা তাদের পজিশন নিয়ে নিল। তারপর পরস্পর অজস্র ধারায় গুলি বিনিময় চলল। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। কিন্তু পাক-সৈন্যরা যখন ভারী মেশিনগান ব্যবহার করতে শুরু করল, তখন রাইফেল সর্বস্ব মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সামনে আর বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দাঁড়িয়ে থাকাটা সমীচীনও ছিল না। তারা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ পেছনে ফেলে রেখে গ্রামের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল।


  1. “প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ' গ্রন্থ থেকে সংকলিত