পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৬৮

গুলিবর্ষণ চলছে। শুধু রাইফেলের আওয়াজ নয়, তারই সাথে সাথে শত শত দৃপ্তকণ্ঠের 'জয় বাংলা' ধ্বনি আকাশ বাতাস মুখরিত করে চলেছে। অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হতে হতে ওদের অনেক সময় কেটে গেল। অস্ত্র চালাতে গিয়েও প্রতিপক্ষের দেখা পেল না, ওরা গোপন আশ্রয়ের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে একটানা গুলিবর্ষণ করে চলেছে। মুক্তিবাহিনীর জয়ধ্বনির উত্তরে আহত ও মুমূর্ষ পাক-সৈন্যদের আর্তনাদ শোনা যেতে লাগল। পুরা এক ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর আর কোন সাড়াশব্দ শোনা গেল না, শান্ত প্রকৃতি আবার শান্ত হয়ে গেছে। পাক- সৈন্যদের দুর্বল প্রতিরোধ কোন কাজেই আসেনি সেই যুদ্ধে একটি মুক্তিযোদ্ধাও মারা যায়নি।

 মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। হামলাকারী পাক-সৈন্যরা বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার নানা জায়গায় ঘাঁটি করে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এই নৃশংষ মানুষ শিকারীর দল গ্রামের পর গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, লোকের যথাসর্বস্ব লুটপাট করে নিচ্ছে, আর যেখানে বিন্দুমাত্র বাধা পাচ্ছে, সেখানে ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। এ এক অসহনীয় অবস্থা। গ্রামের লোক ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এই অসহায় আর নিরুপায় মানুষগুলি কি করবে, কোথায় যাবে পথ খুজে পাচ্ছে না।

 গৌরনদী থানায় যে-মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল ইতিমধ্যে ভেঙে-চুরে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে।

 এই অবস্থায় জনকয়েক তরুণ কর্মী আবার নতুন করে মুক্তিবাহিনীকে গড়ে তোলবার জন্য আলাপ- আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে এবার শুধু গৌরনদী থানা নয়, বরিশাল জেলার গৌরনদী আর ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়া ও কালকিনী এই তিন থানার কর্মীরা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। সেই সময় গৌরনদী থানার পূর্ব-নবগ্রামের একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

 পূর্ব-নবগ্রামটি বরিশাল জেলা আর ফরিদপুর জেলার সীমান্তস্থলে অবস্থিত। পূর্ব-নবগ্রামের উত্তর দিকে একটি সরু খাল তার গা ঘেঁষে চলে গেছে। এই খালের অপর পারে ফরিদপুর জেলার নবগ্রাম। পূর্ব- নবগ্রাম থেকে মাত্র মাইল দেড়েক দূরে মেদাকুল, এখানে পাক-সৈন্যরা ঘাঁটি করে বসে আছে। এটি একটি নমঃশূদ্র অঞ্চল। এখানকার লোকদের মধ্যে অধিকাংশ কৃষক হলেও শিক্ষিত সম্প্রদায়ও আছে। তাদের মধ্যে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও আছে। মাত্র মাইল দেড়েক দূরে শত্রুদের ঘাঁটি। এখানকর বসিন্দারা প্রতিমুহূর্তেই ওদের আক্রমণের আশঙ্কা করছিল। বাইরের কোন কিছু আভাস না পেলেও কয়েকদিন থেকে এদের ভেতরে ভেতরে একটি প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলছিল।

 সরকারী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক সিদ্ধেশ্বর সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারা স্থির করেছিল, যদি সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে তারা ওদের বিরুদ্ধে একহাত দেখে নেবে। পূর্ব-নবগ্রামের শিক্ষিত তরুণ ও সাধারণ কৃষকরা এই উদ্দেশ্যে সংকল্পবদ্ধ হয়ে একজোট হয়ে দাড়িয়েছিল। বরিশাল আর ফরিদপুরের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরা ছেলেবেলা থেকেই লাঠি, সড়কি, লেজা ইত্যাদি অস্ত্র চালনায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। পূর্ব-নবগ্রামের যেসব তরুণরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে তারাও এ বিষয়ে আনাড়ি নয়, তারাও এখানো এই সমস্ত অস্ত্র চালনার অভ্যাসটা হারিয়ে ফেলিনি। এই সুঃসাহসী তরুণরা সঙ্কল্প নিয়েছিল যে, যদি সুযোগ পাওয়া যায়ঃ তাহলে সড়কি, লেজা ইত্যাদি অস্ত্র নিয়েই ওদের রাইফেলের সঙ্গে মোকবিলা করবে। প্রবীণ সিদ্ধেশ্বর সরকারের উদ্যোগে এবং অর্থব্যয়ে এই সমস্ত অস্ত্র তৈরী হচ্ছে। উত্তেজনায় সারাটা গ্রাম গরম হয়ে উঠেছে। রাইফেলের বিরুদ্ধে সড়কি আর লেজা- এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।

 এরা উপযুক্ত সুযোগের জন্য প্রতীক্ষা করছিল। সেই সুযোগ একদিন এসে গেল। ১৩ই মে তারিখে মেদাকুলের ঘাঁটি থেকে মাত্র চারজন সৈন্য পূর্ব-নবগ্রামে এসে প্রবেশ করল। সাধারণ রাইফেল নয়, ওদের সঙ্গে একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেলও ছিল। এখানকার গ্রামাঞ্চলে আসার পর থেকে পাক-সৈন্যরা এ পর্যন্ত কোন দিক থেকেই কোন বাধা পায়নি। গ্রামে ঢুকেই ওরা প্রথমে সিদ্ধেশ্বর সরকারের বাড়িতে গিয়ে হামলা করল। সিদ্ধেশ্বর সরকার বাড়ি ছিলেন না, তিনি তখন এদের উপযুক্ত অভ্যর্থনার জন্য উদ্যোগ আয়োজনে অন্যত্র ব্যস্ত। সরকার-