পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৭২

পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেল। মুক্তিফ্রণ্ট হেমায়েতউদ্দীনকে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার বা সেনাপতির পদে নির্বাচিত করল। অস্ত্রশক্তির দিক দিয়ে এবং সামরিক শিক্ষাব্যবস্থার দিক দিয়ে মুক্তিবাহিনী এবার থেকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল।

 মুক্তিফ্রণ্টের এই বাহিনীতে যোগ দেবার আগে হেমায়েতউদ্দীন তাঁর এই ছোট্ট দলটিতে নিয়ে নিজের বুদ্ধি অনুসারে কাজ করে চলেছিলেন। কোন রাজনৈতিক দলের লোক নন তিনি। তাহলেও সারা প্রদেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন তাদের মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল তারপর বর্বর পাকসৈন্যদের নৃশংস অত্যাচার তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। যে করেই হোক এদের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতেই হবে- এই প্রতিজ্ঞা তার ধ্যান, জ্ঞান আর জপমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল।

 এইভাবে মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে হেমায়েতউদ্দীনের এই ছোট্ট দলটি একান্তভাবে নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করেই কাজে নামল। ৯ই মে তারিখে তাঁরা ফরিদপুরের কোটালিপাড়া থানা আক্রমণ করেছিলেন। থানায় সশস্ত্র পুলিশরা ছিল, দু'চারজন মিলিটারির লোকও ছিল। কিন্তু মেশিনগানের গুলিবর্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করবার মত হিম্মত তাদের ছিল না। তারা আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থানা ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালাল। হেমায়েতউদ্দীন সেখানে বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গুলি পেয়ে গেলেন।

 পাক-সৈন্যরা একটার পর একটা অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। তাদের অধিকার পাকাপোক্ত হয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুসলিম লীগ-পন্থী ও জামাত-পন্থী দালালের দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। গুণ্ডা ও লুটেরার দলও তাদের সঙ্গে হাত মিলাল। হেমায়েতউদ্দীন প্রধান রোখ পড়ল এদের উপর। তিনি বললেন, এই ঘরের ইঁদুরগুলিকে খতম করতে না পরলে মুক্তিসংগ্রামের পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই প্রথমেই এদের শায়েস্তা করতে হবে। এ শুধু কথার কথা নয়, তিনি যা বললেন তা কাজেও পরিণত করে চললেন। অদ্ভূত তাঁর সাহস, প্রকাশ্য দিবালোকে এক হাট লোকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি এই সমস্ত দেশদ্রোহী দালালদের উপর কড়া দাওয়াই প্রয়োগ করতেন। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।

 কিছু দিনের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষ উৎসাহিত হয়ে উঠল, দালালদের হৃৎকম্প জাগল। ওদিকে সামরিক কর্তৃপক্ষও চুপ করে বসে ছিল না। মুক্তিবাহিনীকে চূর্ণ করে দেবার জন্য তারা সদলবলে তৈরী হচ্ছিল। প্রধানত এই উদ্দেশ্যে তারা কোটালীপাড়া থানায় তাদের মূল ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। সৈন্যরা একা, তাদের সঙ্গে ছিল পুলিশ আর রাজাকার বাহিনী।

 এদিকে মুক্তিবাহিনীও তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এবার তাদের সামনে অগ্নিপরীক্ষা। এতদিন তারা এখানে ওখানে ছোটখাট আক্রমণ চালিয়েছে, কিন্তু এরা দস্তুরমত যুদ্ধ। মুক্তিফ্রণ্টের গোয়েন্দা বিভাগের চরেরা সংবাদ নিয়ে এসেছে যে, সৈন্য পুলিশ আর রাজাকার মিলিয়ে বেশ বড় একটা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। একটা সুখবর, ওদের সঙ্গে মেশিনগান নেই। একমাত্র রাইফেলের উপরই তাদের নির্ভর। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর হাতে আছে একটা মেশিনগান আর একটা সাব-মেশিনগান। তাছাড়া রাইফেল তো আছেই। মুক্তিফ্রণ্ট সিদ্ধান্ত নিল, আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ নয়, আগ বাড়িয়ে ওদের উপর আক্রমণ চালাতে হবে। ওদের অপ্রস্তুত অবস্থায় হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের চমকে দিতে হবে। তারিখটা ছিল ১৪ই জুন। গভীর রাত্রিতে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নৌকাযোগে শত্রুদের মূল ঘাঁটি কোটালিপাড়া তানার দিক যাত্রা করল। তাদের ছোট ছোট এক-মাল্লাই নৌকাগুলি রাত্রির অন্ধকারে অতি সন্তর্পণে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ঠিক সেই রাত্রিতেই পাক-সৈন্য বাহিনীও আক্রমণশূলক পরিকল্পনা নিয়ে রাত্রির অন্ধকারে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির দিকে এগিয়ে আসছিল। এই দুই দল হরিণাহাটি নামক গ্রামের কাছে এসে পরস্পরের সম্মুখীন হোল।

 ওদের আটখানা বড় বড় ছিফ নৌকা ছপ্ ছপ্ করতে করতে এগিয়ে আসছে। নৌকাগুলির মধ্যে সৈন্য, পুলিশ আর রাজাকাররা মিলিয়ে প্রায় দু'শো জন লোক ছিল। মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট নৌকাগুলি প্রথমে ওদের